ভারতের মুখোশ খুলে পড়ল : কঠোর বার্তা দিলেন শোলে

0

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি জে বিøঙ্কেনের উপদেষ্টা এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোত্রা’র একই দিনে ঢাকা সফর নিয়ে গতকাল ইনকিলাবে ‘রাজনীতিতে হঠাৎ কৌত‚হল’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কৌত‚হলের কারণ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। ডেরেক শোলে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার করে বার্তা দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র কেমন চায় তা শোলের বার্তা পরিষ্কার। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোত্রাও দিল্লির বার্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তার এই বার্তা ২০১৪ সালের ভোটের আগে সে সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের মতো না হলে মোদি প্রশাসন বাংলাদেশের জনগণের বদলে একটি দলের প্রতি পূর্ণ আস্থার কথা প্রকাশ্যে এলো।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোত্রা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। কিন্তু ডেরেক শোলে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

ঢাকাস্থ আমেরিকান সেন্টারে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সম্পাদকদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে জো বাইডেনের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা সীমিত হয়ে আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের সম্ভাবনা অপরিসীম। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অংশীদারিত্ব পৃথিবীর শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশগুলোর সঙ্গে। কোথাও গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়লে, সে দেশে আমাদের সহযোগিতার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। এর মানে এই নয় যে আমরা সহযোগিতা করব না। ওই দেশের সঙ্গে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সম্পর্ক অর্থবহ হবে না। কিন্তু ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটি সীমিত হওয়ার কারণ হবে। মার্কিন কোম্পানিগুলো কোনো দেশে বিনিয়োগের সময় স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা চায়। মার্কিন প্রশাসনের আন্ডার সেক্রেটারি পদমর্যাদার এই কাউন্সিলর বলেন, মার্কিন কোম্পানিগুলো কোনো দেশে বিনিয়োগের সময় স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা দেখতে চায়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে উন্নয়নের সাফল্যের প্রতীক। দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ খুব ভালো কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। তিনি জানান, ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি গণতন্ত্র, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শক্তিশালী সুশীল সমাজের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে কী হতে পারে’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ডোরেক শোলে বলেন, তিনি এ নিয়ে অনুমাননির্ভর (আগ বাড়িয়ে) কিছু বলতে চান না। আমি বিশ্বাস করি এখানে (বাংলাদেশশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন) একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সরকারের দায়িত্বশীলরা সবাই বলছে, তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন (আসন্ন জাতীয় নির্বাচন) করতে চায়। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে, আগের নির্বাচনের (২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন) বিষয়ে সুশীল সমাজ যে উদ্বেগের কথা বলেছে, আমরাও গোপনীয়তা ছাড়াই আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামনের মাসগুলোতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকবে। তবে নিশ্চিত, আমাদের আস্থা আছে এবং আমরা সরকারের কাছ থেকে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার শুনেছি।

এ সময় বাংলাদেশে গণতন্ত্র দুর্বল হলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সীমিত হতে পারে সতর্ক করেন ডেরেক শোলে জো বাইডেন আয়োজিত বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণ ব্যাখ্যা করেন। আগামী ২৯ ও ৩০ মার্চ ভার্চুয়ালি ওই বৈশ্বিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের ১১০টি দেশের প্রায় সাড়ে সাতশ প্রতিনিধি অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিতব্য এ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। ডেরেক শোলে জানিয়েছেন, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার আগাম অঙ্গীকার তথা রূপরেখা না দেয়ায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয়নি।

এ মতবিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক এনাম আহমেদ, যমুনা টিভির নির্বাহী পরিচালক ফাহিম আহমেদ এবং এএফপির ব্যুরোপ্রধান শফিকুল আলম প্রমুখ।

এর আগে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং সমাজের উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন মৌলিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তাছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতে নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক শাসনের প্রচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব গভীরতর করার বিষয়টি তিনি পুনরায় নিশ্চিত করার প্রতি জোর দেন। ডেরেক শোলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না।

ঢাকা ত্যাগের আগে রাতে নিজের অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে ডেরেক শোলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তোলা নিজের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিগত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে সমর্থন করেছে এবং করে চলেছে। অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব এবং নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক শাসনের প্রচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব গভীরতর করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতে পুনরায় নিশ্চিত করেছি। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। এরপর পৃথক আরেকটি টুইটে ডেরেক শোলে লিখেছেন ‘গণতন্ত্র এবং সমাজের উন্নয়নের জন্য মৌলিক বিষয় হলো মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সদস্যদের কাছ থেকে এই দেশ ও এই অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য গণতান্ত্রিক শাসন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচারে তাদের কর্মকাÐ সম্পর্কে শুনেছি’।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের (মোদি সরকার) পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রা বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ উন্নয়নযাত্রায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে ভারত। বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ১৮তম আসরে শেখ হাসিনাকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বি-পক্ষীয় বন্ধনকে অত্যন্ত দৃঢ় বলে বর্ণনা করে বিনয় কোত্রা বলেন, পুরো বিশ্ব এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে, যা ইতোমধ্যেই কৌশলগত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে।

ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারত সরকার ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) শর্ত সহজ করার চেষ্টা করছেন। ফলে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহজেই ঋণ নিতে এবং তা পরিশোধ করতে পারে। দুই দেশের স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করেই দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা যেতে পারে।

যদিও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ঢাকায় কর্মরত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। কোনো ব্যাক্তি ও দলের সঙ্গে নয়; দেশের মানুষের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক রক্ষা করে থাকে’।

এর আগে ২০২২ সালের ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুঁজায় অংশ গ্রহণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি। আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে (ক্ষমতায়) রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। সেজন্য শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।

উল্লেখ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের সে সময়ের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ দেন। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। নির্বাচনের পর এইচ এম এরশাদ এ তথ্য ফাঁস করে দিয়ে বলেন, সুজানা সিং জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছে। তিনি আমাকে বলেছেন আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

উৎসঃ   ইনকিলাব
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More