শত বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। শতবছর পূর্তি স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী উৎসবের। উৎসবের প্রথমদিন রবিবার বিকেলে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
এ উপলক্ষে বর্ণাঢ্যসাজে সাজানো হয়েছে বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে বিশাল প্যান্ডেলে চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা। আয়োজকরা গত ১৫দিন ধরে উৎসব সফল করতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা জানিয়েছেন, বর্তমান শিক্ষার্থীরা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা ও বিদেশ অবস্থান করা প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা উৎসবে যোগ দিতে ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জে চলে গেছেন। সবমিলিয়ে বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে নবীন প্রবীনের মেলা বসবে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে বিকেল তিনটায় বিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হবেন। বিকেল চারটায় তিনি বক্তৃতা করবেন এবং শত বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও শতবছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানের মিডিয়া উপ-কমিটির আহবায়ক মু আ লতিফ জানান, বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমান ছাত্রদের অংশগ্রহন এবং উপস্থিতিতে ২৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার পর্যন্ত চলবে বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান। সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত স্মৃতিচারণ, আড্ডা, গান, নাচ, নাটক ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গে ভরপুর থাকবে প্রতিদিনের অনুষ্ঠান।
তিনি জানান, আয়োজনে শামিল হতে বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এর মধ্যে দেশ বিদেশে থাকা ১৫০০ ও বর্তমান শিক্ষার্থী রয়েছে ১৫০০। প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মধ্যে মধ্যে ৯০ বছর বয়সী বেশ কয়েকজন ছাত্রও আছেন। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে থাকায়, আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে রেজিস্ট্রেশন কম হয়েছে। নইলে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ত।
আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে শোলাকিয়ায়। বিদ্যালয়টি অনেক কৃতি ছাত্রের পীঠস্থান হিসেবে সুপরিচিত। এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ অবদান রয়েছে।
১৯১৬ সালে কিশোরগঞ্জ শহরে এ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন করিমগঞ্জের সাঁতারপুর গ্রামের সন্তান শিক্ষানুরাগী মুন্সি আজিম উদ্দিন আহমদ। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে সে সময় বিদ্যালয়টি ‘আজিম উদ্দিন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়’ নামে চালু করেছিলেন তিনি। প্রথম বছর তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি করা হয়। বাঁশের খুঁটি ও টিনের ছাপরা ঘরেই শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। মুন্সি আজিম উদ্দিনের বাসার সামনেই শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। কিছুদিন পর ঘরটি ভেঙে পড়লে বিদ্যালয়টি শোলাকিয়া এলাকায় নিয়ে স্থাপন করেন তিনি। সেখানে রেল লাইনের পূর্ব পাশে বিদ্যালয়ের জন্য জমি কেনেন তিনি। গড়ে তোলা হয় বিদ্যালয়ের নতুন ঘর। বিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় হীরণ চন্দ্র গোস্বামী নামের একজনকে। এর পর প্রধান শিক্ষক হন বসন্ত কুমার চক্রবর্তী। তাঁর সময়েই বিদ্যালয়টি ঘুরে দাঁড়ায়। মাত্র ছয় বছরে বিদ্যালয়টির নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। ১৯২২ সালে এ বিদ্যালয়ের ছাত্র রেবতী মোহন বর্মণ অবিভক্ত বাংলায় এন্ট্রান্স পরীক্ষার কলকাতা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি পরে কলকাতা ন্যাশনাল বুক এজেন্সি (এনবিএ) প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিনি একজন সু-লেখক, রাজনীতিাবদ ছিলেন। তাঁর অসংখ্য লেখার মধ্যে ‘সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ ‘ক্যাপিটাল’ ‘অর্থনীতির গোড়ার কথা’ ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ উলে-খযোগ্য।
রেবতি মোহন এ বিদ্যালয় থেকে ভালো ফল করায় দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যালয়ের নাম। এ বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিদ্যালয়টিকে স্থায়ী মঞ্জুরি প্রাপ্তির তালিকাভূক্ত করে। এর পর বিদ্যালয়টি আরো উন্নতির দিকে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বসন্ত কুমার চক্রবর্তী দেশ ছাড়েন। এর পরে ১৯৫১ সালে মহেন্দ্র কুমার চক্রবর্তীর পর প্রধান শিক্ষক হন মো. মতিউর রহমান। তিনি আসার পর বিদ্যালয়ে নতুন করে প্রাণ ফিরে আসে। সে সময় শিক্ষায় অবদান রাখায় মতিউর রহমান তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন।
বিদ্যালয়টি জন্মলগ্ন থেকেই স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্রীড়া ও খেলাধুলায়ও বিশেষ সুনাম অর্জন করে আসছে। এ বিদ্যালয়ের ছাত্র চুনিলাল গোস্বামী কলকাতার মোহনবাগান ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। বিখ্যাত ফুটবলার আবদুর রহমান চাঁন মিয়া এ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
১৯৭০ সালে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্কাউটার মো: রমজান আলীর নেতৃতে বিদ্যালয়ের স্কাউট দল জাতীয় জাম্বুরিতে অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় ডিসপ্লেতে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।
শত বছরে এ বিদ্যালয়টি অসংখ্য জ্ঞানী গুণী কবি সাহিত্যিক রাজনীতিকের জন্ম দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ বিদ্যালয়েরই ছাত্র। বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম ওসমান গণি এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ড. ওসমান গণি অত্র বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। কৃষিবিদ ড. এম কাদের, শিক্ষাবিদ ড.ম আখতারুজ্জামান এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। এ ছাড়াও বিশিষ্ট নাট্যকার আব্দুল¬াহ আল মামুন, কবি আবিদ আজাদ, ধারাভাষ্যকার নাজমুল হুদা, নৃত্য শিল্পী শুক্লা সরকার এ বিদ্যালয়ের ছাত্র। সেনাবাহিনীর (অব) লেফটেনেন্ট কর্ণেল ডাক্তার জেহাদ খান এ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন মেজর এম. শফিউল¬াহর নেতৃত্বে এক প্লাটুন সেনাবাহিনী এ বিদ্যালয়ে অবস্থান করে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে বহু লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেন। বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমানের পুত্র ও বিদ্যালয়ের ছাত্র আতিকুর রহমান ৭১ সালে ভৈরবে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক আফতাব উদ্দিন ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। ২০০৮ সাল থেকে এ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঢাকার বাংলা একাডেমীতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র আয়োজিত ‘জাতীয় দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহণ করে প্রতিবছরই প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভ করে আসছে।
Prev Post