রক্তের মূল্য রক্তে পরিশোধ

0

blood[ads1]‘রক্তের মূল্য রক্ত দিয়ে পরিশোধ করতে হবে।…’, ‘আমি আর জঙ্গি-ফঙ্গি নিয়ে কাজ করব না।… তবে এখন থেকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। যুদ্ধ করব।’ চলতি সপ্তাহে পরপর দুটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে এমন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন জঙ্গি-সন্ত্রাসী দমনে নবগঠিত কাউন্টার টেরোটিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. ছানোয়ার হোসেন। রাজধানীতে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ‘যম’ এই ছানোয়ার। দীর্ঘদিন ধরে ডিবিতে এ নিয়ে কাজ করছেন আমেরিকায় বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়া এই পুলিশ কর্মকর্তা। রোববার (৫ জুন) চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ফেসবুকে ওই স্ট্যাটাস দিয়ে ভেতরের ক্রোধ আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেন এডিসি ছানোয়ার।
রাজধানী ও এর বাইরের বেশ কয়েক এসপিসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু ছানোয়ার নন, এটিই অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তার মনের কথা। মিতু ভাবির মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ওইসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে লড়াই আরো বেগবান করবে পুলিশ। তাদের বক্তব্য, পুলিশ পরিবারের নিরপরাধ সদস্যদের ওপর কাপুরুষোচিত হামলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এবার জঙ্গিদের রেহাই নেই।
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পর মঙ্গলবার রাত থেকে সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী কঠোর অভিযানে নেমেছে পুলিশ। এর মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যদের ‘কঠোর বার্তা’ দিতে চায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এসপির স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশ প্রশাসনও জঙ্গিদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড বন্ধে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে দফায় দফায় বৈঠক হয়। সর্বশেষ গতকালের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় দেশজুড়ে জঙ্গি গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর। এর আগে গত তিন রাতের বিশেষ অভিযানে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পাঁচ জঙ্গি সদস্য নিহত হয়। বুধবার রাতে গাইবান্ধায় ও মঙ্গলবার রাতে বগুড়ায় দুই জেএমবির জঙ্গি নিহত হয়। এর আগের রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকারীসহ রাজধানীতে দুই জঙ্গি ও রাজশাহীর গোদাবাড়ীতে আরো এক জঙ্গি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে। এ ছাড়া গত ৭ মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে আরো ৬ জঙ্গি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, গত দেড় বছরে দেশের ১৫টি জেলায় ৪৬টি জঙ্গি হামলায় ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। এসব সন্ত্রাসী হামলার ২৫টির সঙ্গে জেএমবির সংশ্লিষ্টতার তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ১০টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবিটি। বাকিগুলোর সঙ্গে অন্যান্য সংগঠন জড়িত। বর্তমানে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছয়টি জঙ্গি সংগঠন থাকলেও এবিটি ও জেএমবি বেশি সক্রিয়। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রী হত্যার সঙ্গে জেএমবির সদস্যরা জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সব ভিভিআইপি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। উগ্রপন্থিদের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করে পুলিশ সদর দফতরে পাঠাতে এসপিদের বলা হয়েছে। চলমান জঙ্গিবিরোধী অভিযানে শুধু উগ্রপন্থিরা নয়, তাদের স্বজনদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে। উগ্রপন্থিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি প্রয়োজনে তার স্বজনদের আইনের আওতায় নেয়া হবে। কারাবন্দি জঙ্গিদের সঙ্গে কারা দেখা করতে আসেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এর মাধ্যমে তথাকথিত ইসলামী খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে যেতে চায় তারা। দেশে খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক নিজেদের শক্তির জানান দিতে জঙ্গি হামলা চালায় জেএমবি। সমান্তরালভাবে আরেক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমও তাদের শক্তির জানান দিতে একের পর এক মুক্তমনা লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যা শুরু করে। আর তাদের ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপর হয়ে ওঠে। র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতার মধ্যেই জঙ্গিরা বিদেশি নাগরিক, পীর, ফকির, পুরোহিত, বৌদ্ধভিক্ষু, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করে যাচ্ছে। হামলা চালাচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। এর আগে দুই  পুলিশ সদস্যকেও হত্যা করেছে জঙ্গিরা।

[ads2]
এদিকে সাম্প্রতিক ধারাবাহিক টার্গেট কিলিংকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা আমি অনেকবার বলেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জঙ্গি গ্রেফতারে প্রয়োজনে দেশজুড়ে কম্বিং অপারেশন চালাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, টার্গেট কিলিং কখনোই ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে এটি আগাম প্রতিরোধের জন্য জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমরা কাজ করছি। পুলিশ এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। এখন আমরা পুলিশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছি। পুলিশের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় কোথায় কী ত্রুটি আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সারাদেশে জঙ্গিদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা হচ্ছে।
নেপথ্যের হোতা কারা?: জঙ্গি নিয়ে কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম পৃথক ‘সেল’ তৈরি করে অপারেশন করছে। এবিটির শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন পলাতক মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল হক জিয়া। এবিটির তিন সদস্যের একটি অপারেশনাল ‘কোর কমিটি’ রয়েছে। তার প্রধান হিসেবে আছেন পলাতক মেজর জিয়া। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১। শরিফুল একাই আটজন লেখক-প্রকাশক ও ব্লগার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ ও পরিকল্পনায় ছিলেন। এ ছাড়া লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টায় ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে কারাবন্দি মাওলানা সাইদুর রহমান ও নজরুল জেএমবির নেতৃত্বে আছেন। জেএমবি বর্তমানে দুটি ধারায় বিভক্ত। জেএমবির যেসব সদস্য কারাগারে আছেন, তারা সাইদুরপন্থি হিসেবে পরিচিত। বাকিরা নজরুলপন্থি হিসেবে পরিচিত।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে জেএমবির দু’জন সামরিক কমান্ডার বিভিন্ন অপারেশনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। জেএমবির দুই সামরিক কমান্ডারের আওতায় ৩০-৩৫ জন সদস্য রয়েছেন। ওই দুই সামরিক কমান্ডারকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সফলতা নির্ভর করছে। ওই সূত্র মতে, জেএমবির অন্তত চারজন সামরিক কমান্ডার রয়েছেন। তার মধ্যে আলবানি ওরফে হোজ্জা ও ফারদিন এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জেলা পর্যায়ে দায়িত্বরত পুুলিশ সদস্যরা উগ্রপন্থি জঙ্গিদের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত রাখেন না। জঙ্গিরা হামলার ব্যাপারে যে ধরনের কৌশল ব্যবহার করে, মাঠ পর্যায়ের পুলিশ তা মোকাবিলা করতে অভ্যস্ত নয়। এসব জঙ্গির শেকড়সহ নির্মূল করতে হলে শুধু ঢাকা বা অন্যান্য মহানগরীতে নয়, সব জেলা পর্যায়ে এ ব্যাপারে দক্ষ ও চৌকস পুলিশ কর্মকর্তার দরকার।
এসপির স্ত্রী হত্যা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মনিরুল: বিদেশি মদতে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাবুল আক্তারের স্ত্রী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে এ ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাকে খুঁজে বের করা হবে। উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে এসব অপশক্তি প্রতিহত করা হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই উগ্রপন্থি জঙ্গিদের মোকাবিলা করবে পুলিশ। মনিরুল বলেন, পুলিশের মনোবল এত ঠুনকো নয়, তাই ভাঙার প্রশ্নই আসে না। পুলিশ শোককে শক্তিতে পরিণত করে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখবে।[ads2]

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More