তুরস্ক, সিরিয়াজুড়ে মানবতার আর্তনাদ। চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ। মানুষ অসহায় চিৎকারে বুক ফাটাচ্ছে। তাদের সান্ত্বনা দেয়ারও যেন কেউ নেই। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন অসংখ্য মানুষ। তাদের পরিণতি জানা যায়নি। তবে সময় যত পার হচ্ছে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত ক্ষীণ হচ্ছে। গতরাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৫০০০ অতিক্রম করেছে। শুধু তুরস্কেই নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৩৪১৯। এর সঙ্গে আছে সিরিয়া।
এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা দিয়েছে যে, দুই দেশে নিহতের সংখ্যা ২০,০০০ দাঁড়াতে পারে। তুরস্কে চলছে এক সপ্তাহের শোক। এ সময়ে দেশে ও দেশের বাইরে দেশটির মিশনে জাতীয় পতাকা রয়েছে অর্ধনমিত। সোমবার ভূমিকম্পে ভয়াবহতার পর এ নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। ওদিকে নিহতের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে আসছে বাঁচার আকুতি। সরকারি হিসাবের বাইরে নিহতের সংখ্যা বহুগুণ বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যারা বেঁচে আছেন, তাদের সামনে কেয়ামতের আলামত।
যে শহরকে দেখে ঘুমাতে গিয়েছিলেন, তা তেমন নেই। এক রাতের ভেতর, ঘুমের ভেতর তা পাল্টে গেছে। চারদিকে ধ্বংসলীলা। এর সঙ্গে তুলনা করার মতো কিছু নেই। ভবনের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন বহু পরিবারের সবাই। যারা বেঁচে আছেন, তারা প্রিয় স্বজনের খোঁজে রুদ্ধশ্বাস ছুটছেন ধ্বংসস্তূপের দিকে। কিন্তু তার ভেতর থেকে মৃত হোক বা জীবিত হোক, কাউকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তবুও উদ্ধারকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তারা মৃতদেহ বের করে যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে নেমে আসছেন, তখন নিজেরাই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যাচ্ছে। উপস্থিত জনতাও কান্নার বাঁধ মানাতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। এ অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় দিনরাত কাটাচ্ছে মানুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল মৃতের সংখ্যা। প্রতি আপডেটেই শত শত নতুন মৃত্যু যুক্ত হচ্ছিল। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, তুরস্ক ও সিরিয়া- দুই দেশে কমপক্ষে ৫০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি।
এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও সতর্ক করে বলেছে এ সংখ্যা আটগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১১ হাজারের বেশি ভবন ধস ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ডব্লিউএইচও কর্মকর্তা ক্যাথরিন স্মলউড বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ভূমিকম্পের কারণে বহু মানুষ তাদের বাড়িঘর হারিয়েছে। তাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। তুষারপাতের কারণে তীব্র ঠাণ্ডায় তাদের জন্য বিপদ আরও বাড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন। দুই দেশেই হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে। বারো তলা বিল্ডিংও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, রাস্তা ধসে গেছে। চোখ যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত শুধু ধ্বংসস্তূপের পাহাড়। সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ভূমিকম্পের পর শতাধিক আফটারশক রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার ভোরবেলা যখন ঘড়িতে সময় প্রায় ৪টা, ঠিক তখনই এই ৭.৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। বেশির ভাগ মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বহুতল ভবন ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। মোমের মতো ধসে পড়ে ভবনের পর ভবন। সঙ্গে সঙ্গে লাশ। লাশ আর লাশ। চারদিকে শুধু লাশ। এত লাশের ভার নিয়ে দেশ দু’টির আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। যারা বেঁচে আছেন, হতাশায় তাদের চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝে উঠতে পারছেন না যে, এখনো বেঁচে আছেন। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কম্পন অনুভূত হয়েছে মিশর, নেবানন, সাইপ্রাস থেকেও। বিবিসি বলছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ১৯৩৯ সালের পর একে তার দেশের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সিরিয়ায় নিহতদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। এই অঞ্চলটির সীমান্তের উভয় পাশে শিবিরগুলোতে লক্ষাধিক সিরীয় শরণার্থীর আবাসস্থল। তুরস্ক সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক আবেদন জানানোর পর বিশ্ব নেতারা সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুর্গত এলাকা থেকে যেসব মর্মান্তিক ছবি পাওয়া যাচ্ছে তাতে বাসাবাড়ি ও সড়কে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকদের সন্ধানকারী উদ্ধারকারী দলগুলোকে মরিয়া হয়ে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। তুরস্কের ১০টি শহর ও প্রদেশের স্কুল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি হাতায়, মারাশ এবং আন্তেপের বিমানবন্দরগুলো বন্ধ বা আংশিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল প্রতিবেশী তুরস্কে হলেও সিরিয়াতেও বহু মানুষ মারা গেছে। এই দুর্যোগের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও এবং ছবিতে উঠে আসছে সেসব দৃশ্য। আলেপ্পোর উত্তর-পশ্চিমে এক শহর থেকে পাওয়া এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ভবনগুলো ধসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর বিশাল মেঘের মধ্যদিয়ে বাসিন্দারা পালিয়ে যাচ্ছেন এবং চিৎকার করছেন। ভূমিকম্পে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই সেখানে চিকিৎসাসেবা এবং জরুরি সরবরাহের সুযোগ সীমিত। সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করা একটি ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেট জরুরি সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছে। হাসপাতালগুলো থেকে জরুরিভাবে রক্তদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে ৩ মাসের জরুরি অবস্থা
ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। শুধু তুরস্কে নিহতের সংখ্যা ১৩০ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৩৫৪৯। এ ঘোষণা দিয়ে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন। তিনি বলেন, বিপন্ন ভূমিকম্প কবলিত জোনে আছে দেশটির কমপক্ষে ১০টি শহর। সাহায্যের নিশ্চয়তা পেয়েছেন ৭০টি দেশ থেকে। তিনি গৃহহীন মানুষদের অস্থায়ী আবাস হিসেবে আন্তালয়ার হোটেলগুলোকে ব্যবহারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
ভূমিকম্পের ভয়াবহতার মধ্যেও তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে যুদ্ধ অব্যাহত
ভূমিকম্পে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ। শোকে কাঁদছে মানুষ। ভয়াবহ ঠাণ্ডায় জীবিতদের করুণদশা। বিশ্ব মানবতা হতবিহ্বল সেখানকার ভয়াবহতায়। নিহতদের স্মরণে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো হচ্ছে সহায়তা ও উদ্ধারকারী দল। কিন্তু এই কঠিন করুণ পরিণতির পরও সশস্ত্র ওয়াইপিজি ও পিকেকে গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে নিবৃত করতে পারেনি তুরস্ককে। অনলাইন আল জাজিরা লিখেছে, তুরস্ক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে হতাহতদের উদ্ধারে হাজারো মানুষ যখন ব্যস্ত, তখন অভিন্ন সীমান্তে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। মঙ্গলবার তুরস্কের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ওয়াইপিজি এবং পিকেকে নামের সশস্ত্র গ্রুপ রকেট হামলা করেছে। এর জবাবে তাদেরকে টার্গেট করেছে তুরস্ক। সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় এই হামলা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তুরস্কের দক্ষিণের প্রদেশ কিলিসে অনকুপিনার সীমান্ত পোস্টের কাছে একটি এলাকায় সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তাল রিফাত থেকে বহু রকেট হামলা চালিয়েছে এসব গ্রুপ। তবে এতে তুরস্কের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
যেন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ
যেন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ হয়েছে। তুরস্ক সফরে থাকা বৃটেনের ইয়র্কশায়ারের ২৯ বছর বয়সী টিমোথি হোয়াইটনিং তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন এভাবে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় একটি গেস্ট হাউজে ছিলেন। ঘুমাচ্ছিলেন। আকস্মিক ঝাঁকুনিতে তিনি জেগে ওঠেন। দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকেন। ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তবে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বিবিসিকে বলেন, ভূমিকম্পের সময় আমি একটি দ্বিতল ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিলাম। মনে হচ্ছে আমি খুবই সৌভাগ্যবান। ফলে আমাদের ওপর আর কোনো ফ্লোর ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল না। আশপাশের ভবনগুলো কীভাবে এক ফ্লোরের ওপর আরেক ফ্লোর পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সে কথা বুঝাতে গিয়ে তিনি এসব বলেন। তিনি বলেন, ভূমিকম্প যেন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। পুরো শহর মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আমাদের অন্যদিকে ৫ থেকে ৬ তলা বিশিষ্ট অনেক ভবন ছিল। তার কিছুই নেই। টিমোথি অবস্থান করছিলেন আন্তাকিয়ার হাতায়ে শহরে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসেন। তারপর একটি গাড়ি ধরে চলে যান আদানায়। এখন সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি। টিমোথি বলেন, চারদিক থেকে মানুষজন ছুটে যাচ্ছিল। তাদের অর্ধেকেরই বেশি খালি পায়ে। পুরো দৃশ্য নৈরাজ্যকর। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মানুষের বাঁচার আকুতি বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমরা তাদেরকে বের করে আনতে পারিনি।