বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে যারা জনগণের উপর নির্মম অত্যাচার ও শোষণ চালিয়ে নিজ দেশের সম্পদ পাচার করে, নিজেদের পরিবারের সদস্যদের উন্নত দেশে পাঠিয়ে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজেরাও সেসব দেশে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, তাদেরকে দমন করার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো ম্যাগনিটস্কি এক্ট। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাংলাদেশ সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আমরা আগের চেয়েও অধিক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল সিনেটের সদস্য এবং গ্রিনস পার্টির নেতা সিনেটর ডেভিড শুব্রিজ এ কথা বলেন।
১০ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল ভয়েস ফর হিউম্যানিটির যৌথ উদ্যোগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। লাকেম্বা স্পোর্টস ক্লাব কমিউনিটি হলে আয়োজিত এই বৈঠকে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশের নির্বাসিত সাংবাদিক, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি এই প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশের নির্বাসিত সাংবাদিক, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান
“মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আহবান” শীর্ষক এই আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ছিলেন-অস্ট্রেলিয়ান সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধি, অস্ট্রেলিয়া বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং শ্রীলঙ্কান, ভারতীয়, পাকিস্তানী, ফিলিস্তিনি সহ বিভিন্ন কমিউনিটির প্রতিনিধিবৃন্দ।
অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী কমিউনিটির নেতা আঙ্কল ডেভিড বেল এই গোল টেবিল বৈঠকের শুরুতে দক্ষিণ গোলার্ধের বিপুল আয়তনের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় চল্লিশ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসকদের পরিচালিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অতীত, বর্তমান এবং উদীয়মান মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত অধিকারের বর্ণনা দিয়ে ডেভিড বেল বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার করার জন্য সময় কিংবা বিলম্ব কোন ধর্তব্য বিষয় নয়। আদিবাসীদের প্রতি অবিচারের পর শত শত বছর অতিক্রান্ত হলেও এখন তার প্রতিকার হচ্ছে এবং এই প্রতিকারের জন্য এখনো অনেক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া বাকী আছে।
গোল টেবিল বৈঠকের মূল প্রবন্ধে আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে গত বছরের মানবাধিকার দিবসে আমেরিকান ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞার ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এ নিষেধাজ্ঞার পরও বাংলাদেশের বেপরোয়া ও নির্লজ্জ স্বৈরাচারী সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বিরত হয়নি। যার পরিণতিতে সম্প্রতি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ও জাপানী রাষ্ট্রদূত সহ কূটনৈতিক মহলের সদস্যরা এ বিষয়ে অধিকতর সরাসরি বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু অন্যদিকে দখলদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ‘হাড্ডি ভেঙ্গে দেয়া এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয়া’র হুমকি দেয়ার মতো কাজ করেই যাচ্ছেন। এই ধরণের ফ্যাসিস্ট ও মানবাধিকার বিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ও গণতন্ত্রকামী জনগণ আন্তর্জাতিক মহলের অধিকতর শক্তিশালী সমর্থন প্রত্যাশা করে।
ড. মাহমুদুর রহমানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পর এ প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই সিনেটর ডেভিড শুব্রিজ বলেন, কাকতালীয়ভাবে যেদিন এই গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেদিনই অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরান এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অস্ট্রেলিয়ান নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ যাবত বাংলাদেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের উপর যে নজিরবিহীন দমন নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে এবং গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটিতে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তার প্রতি অস্ট্রেলিয়ান সরকার এখনো কোন উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে তার দেশের সরকারের আরো অনেক বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার পরও বাংলাদেশ সরকার যে গোঁয়ার্তুমি প্রদর্শন করছে তা নজিরবিহীন। এই প্রেক্ষাপটে দেশটির সরকারী পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি তার সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পার্লামেন্টে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম টাইমস পত্রিকার সম্পাদক ও অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী সাংবাদিক জিয়া আহমেদ বলেন, ইরান ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা আজকের নিষেধাজ্ঞা যতটা না মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, তারচেয়ে বেশি আদর্শিকভাবে প্রভাবান্বিত একটি সিদ্ধান্ত। অস্ট্রেলিয়ার সরকার যদি মানবাধিকারের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিতে চায় তাহলে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ভারতীয় সরকার এবং বাংলাদেশে জনগণের উপর নিপীড়ন চালানো বাংলাদেশ সরকারের মতো পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের লিয়াজো অফিসার আশরাফুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে দুঃখজনক পরিণতি হলো কোন ধরণের ন্যায়বিচার ও প্রতিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যে বাহিনী র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ান বা র্যাবের বিরুদ্ধে আমেরিকা গত বছর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এ বছর অক্টোবরে সেই র্যাবকেই ব্রিটিশ সরকার প্রশিক্ষণ দিয়েছে মর্মে সম্প্রতি একটি খবর ফাঁস হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের জন্য কুখ্যাত এই বিশেষ বাহিনীকে এরপরও প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তাদের ‘ট্যাক্সপেয়ার’ জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্যাসিফিক এন্ড সাউথইস্ট এশিয়া ক্যাম্পেইনার ভেরোনিকা কোমান বলেন, যদি কয়েকটি দেশের সরকার একসাথে কোন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাই-ল্যাটারাল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন নিরপেক্ষ সংগঠন হিসেবে এমনেস্টিও সেই নিষেধাজ্ঞাকে আমলে নিতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ব্যবসা, অর্থনৈতিক, ভ্রমণ, সামরিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা পর্যায়ে হতে পরে। তিনি বলেন বাংলাদেশে যে নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তা এখন বিশ্বের সব দেশেই মোটামুটিভাবে সবাই জেনে গেছে। ইরান ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ান নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে এখনই অস্ট্রেলিয়ান সরকার ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বিবেচনায় আনার অনুরোধ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা একজন হিউম্যান রাইটস এম্বাসেডর নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন। সুতরাং আশা করা যায় যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দেশটি চিন্তাভাবনা করছে।
এ সময় গোল টেবিল বৈঠকের উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে শ্রীলঙ্কার তামিল কমিউনিটির নেত্রী রেনুগা ইনপাকুমার, ইসলামিক চ্যারিটি প্রজেক্ট এসোসিয়েশনের কমিউনিটি এনগেজমেন্ট অফিসার, এম্বাসেডর ফর পিস এবং ফিলিস্তিনি কমিউনিটির নেতা যিয়াদ আল দাউদ, ট্রাইব্যুনাল ইন্টারন্যাশনালের সম্পাদক ও পাকিস্তানী কমিউনিটির নেতা সাইয়েদ আতিকুর রহমান, ফাইভ নিউজ অস্ট্রেলিয়ার সম্পাদক ও হানিফ বিসমি শো এর পরিচালক হানিফ বিসমি তাদের নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বর্ণনা দেন।
মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন রিফিউজি এডভাইস এন্ড কেসওয়ার্ক সার্ভিস সংগঠনের কমিউনিটি লিয়াজোঁ অফিসার ফরিদ গালিব, রিফিউজি একশন কোয়ালিশন সংগঠনের প্রতিনিধি জেমস সাপল, বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা ফারুক আহমেদ খান, অস্ট্রেলিয়া বিএনপির নেতা মো. মোসলেহ উদ্দিন হাওলাদার আরিফ, জিয়া ফোরাম অস্ট্রেলিয়ার নেতা সোহেল ইকবাল ও জাকির আলম লেনিন, মানবাধিকার কর্মী হাবিবুর রহমান, কেয়ার বাংলাদেশের প্রতিনিধি ফারুক হোসাইন, রাজনৈতিক কর্মী মুন্নি চৌধুরী মেধা প্রমুখ। আলোচনার মাঝে একই দিনে বাংলাদেশের ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া বিএনপির মহাসমাবেশের উপর সরকারী দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদে ‘এবার চলো ঢাকা’ শীর্ষক গান পরিবেশন করেন জনতার কবিয়াল নামে খ্যাত শিল্পী রাহাত শান্তনু।
সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভ সংগঠনটির সেক্রেটারি শিবলী সোহায়েলের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা শীর্ষক এই গোল টেবিল বৈঠকের সমাপনীতে সুপ্রভাত সিডনির সম্পাদক ড. ফারুক আমিন এবং উপদেষ্টা ও সুপ্রভাত সিডনির প্রধান সম্পাদক আবদুল্লাহ ইউসুফ শামীম সকল আলোচনায় অংশগ্রহণকারী এবং উপস্থিতি সুধীমন্ডলীর প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।