রাজ্জাক জুটের ৭০ কোটি টাকা লোপাট: রপ্তানিকারক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের কারসাজি

0

রপ্তানিকারক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয় অর্ক এন্টারপ্রাইজ ও এক্সিলেন্স ইমপেক্সের স্বত্বাধিকারী বিবেক সাহা এবং সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এই অর্থ লোপাটে জড়িত। জালিয়াতির অভিযোগে ইতোমধ্যেই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা (অ্যাডমিরাল স্যুট ১১,১২, ১৯/২০২২) হয়েছে। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে আইনি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাসার খান যুগান্তরকে বলেন, দেশের প্রচলিত নিয়ম মেনে বৈধভাবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছি। এর আগেও স্থানীয় রপ্তানিকারকের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করেছি। কিন্তু এমন প্রতারণার শিকার হব কখনোই ভাবিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ না নেয় তাহলে ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

তিনি বলেন, জাহাজ কোম্পানি বিএস শিপিংয়ের সঙ্গে যোগসাজশে অর্ক এন্টারপ্রাইজ এবং এক্সিলেন্স ইমপেক্সের স্বত্বাধিকারী বিবেক সাহা আরেকটি বড় দুর্নীতি করেছেন। ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট সব ডকুমেন্ট জমা থাকলেও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে তিনি পণ্য খালাস করে নিয়েছেন। বিষয়টি জেনে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবগত করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো সদুত্তর দেয়নি।

যেভাবে লোপাট ৭০ কোটি টাকা : মামলার এজাহার ও রপ্তানিসংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র অনুসারে, ২০১০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুতা রপ্তানি করে আসছে রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি সুতা রপ্তানি করে আয় করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

স্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অর্ক এন্টারপ্রাইজ এবং এক্সিলেন্স ইমপেক্সের স্বত্ত্বাধিকারী বিবেক সাহা ২০২০ সালে রাজ্জাক জুট মিলে উৎপাদিত সুতা রপ্তানির প্রস্তাব দেন। ব্যবসায়িক আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ২০২১ সালে বিবেক সাহার নিয়োজিত শিপিং এজেন্ট বিএস শিপিং লাইনস লিমিটেডের মাধ্যমে ৫৫টি ও অন্যান্য শিপিং লাইন্সের মাধ্যমে ২১টি ক্রয়াদেশে ৩ হাজার ১৭৮ টন সুতা রপ্তানি করে। যার বাজার মূল্য ৬৬ লাখ ৪ হাজার ১০২ মার্কিন ডলার। রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ ৭৬টি কমার্শিয়াল ইনভয়েসের মাধ্যমে এ পরিমাণ সুতা কাস্টম ক্লিয়ারেন্স ও রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় ডিক্লারেশন সম্পন্ন করে।

রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করার জন্য ব্যাংক এশিয়ার উত্তরা শাখার ইস্যু করা ৭৬টি বিল অফ লেডিং ও অন্যান্য শিপিং ডকুমেন্ট স্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অর্ক এন্টারপ্রাইজ এবং এক্সিলেন্স ইমপেক্স সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল লোকাল অফিসে জমা দেয়।

এরমধ্যে একাধিকবার ব্যাংক এশিয়া উত্তরা শাখার মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে রপ্তানি বিলের বিপরীতে দ্রুত মূল্য পরিশোধ করতে তাগাদা দেয়। বিল না পেয়ে রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে স্থানীয় রপ্তানিকারক বিবেক সাহা এবং বিএস শিপিং লাইনস লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা রপ্তানি করা পণ্যের অবস্থা জানাননি। উলটো নানাভাবে হয়রানি করেছেন।

তাদের পারস্পরিক যোগসাজশে বিল অফ লেডিংগুলোর বিপরীতে রপ্তানি করা বিপুল পরিমাণ পাটের সুতা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জাহাজ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৫৫টি ডকুমেন্টের অনুকূলে পাঠানো পণ্যের বিপরীতে বাংলাদেশে কোনো মার্কিন ডলার আসেনি। এই পরিমাণ অর্থ বিবেক সাহা এবং বিএস শিপিং আত্মসাৎ করেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের রহস্যজনক ভূমিকা: অপরদিকে বাকি ২১টি ডকুমেন্টের অনুকূলে পাঠানো পণ্যের বিপরীতে রপ্তানি মূল্যের কিছু অংশ সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে বিবেক সাহার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। পরবর্তীতে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিবেক সাহা প্রায় ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩৮ ডলার ওই অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেন। অবশিষ্ট ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৩৯৩ ডলার তুরস্ক থেকে এখনো আসেনি। এসব টাকার কিছুই রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ পায়নি।

ওই ডলার দেশে আসার আগেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সোনালী ব্যাংক তুরস্কের ব্যাংকের কাছে ডকুমেন্ট রিলিজ করে দেয়। ফলে অবশিষ্ট টাকা আসাও অনিশ্চিত। সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান ও চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকীর কাছে বারবার চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানালেও রহস্যজনক কারণে তারা নীরব ছিলেন।

এদিকে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্যের বিপরীতে ব্যাংক এশিয়া উত্তরা শাখার ইএক্সপিগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে ওভারডিউ হিসাবে দেখাচ্ছে। ফলে রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রপ্তানি মূল্যের বিল পাওয়ার জন্য সোনালী ব্যাংককে নির্দেশ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একাধিকবার আবেদন করলেও তাতে সাড়া আসেনি।

আর এই অজুহাতে রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজের ১৯ কোটি টাকার এফডিআর আটকে রেখেছে ব্যাংক এশিয়া। অথচ তাদের কাছে রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কোনো ঋণ নেই।

এ ব্যাপারে অর্ক এন্টারপ্রাইজ এবং এক্সিলেন্স ইমপেক্সের স্বত্বাধিকারী বিবেক সাহার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। সরেজমিন তার অফিসে গিয়ে জানা যায়, এসব অর্থ আত্মসাতের ঘটনার পর থেকে তিনি দেশের বাইরে আছেন।

Jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More