সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমেছে। সে কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছে না সরকার। আর তাই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়ছেই। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি মাস শেষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ০২ লাখ কোটি টাকা। গতবছরের ডিসেম্বর শেষে এ পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তফসিলি ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার, যা আগের মাসে ছিল ৮৬৩ কোটি টাকা। এক মাসইে তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে খাত থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
ব্যাংকার এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতোমধ্যেই তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া ব্যাংকিং খাতে আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মতে, এর ফলে আমানত এবং ঋণের বাধ্যবাধকতা পূরণে এ খাত বাজেভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এতে ঋণ দানে আরও কঠোরতা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে। সে কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছে না সরকার। উল্টো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে। আশানুরূপ বিদেশি ঋণ-সহায়তাও আসছে না। আর তাতে বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ফলে তারল্য সঙ্কট আরও তীব্র হতে পারে। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত এ পরিস্থিতির সামাল দেয়া। তাদের এটা নিশ্চিত করা উচিত, তারল্য সঙ্কট যাতে সামনে না বাড়ে এবং ঋণযোগ্য তহবিল যাতে না কমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি মাস শেষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ০২ লাখ কোটি টাকা। গতবছরের ডিসেম্বর শেষে এ পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, মূল্যস্ফিতি কমাতে দেশের মানি সার্কুলেশন থেকে জানুয়ারিতে এই পরিমাণ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে পাঠিয়েছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ফলে মাঝে মাঝে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, তাই সরকার এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নির্ভরশীলতা কমে যাওয়া ভালো বলে উল্লেখ করেন ডা. মুস্তাফিজুর রহমান।
গতবছরের ডিসেম্বর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২১ লাখ কোটি টাকা। জানুয়ারি শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০২ লাখ কোটি টাকায়। গত এক মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের নিট হিসাবে দেখা গেছে, এই সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৬ দশমিক ৪৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের ১১ দশমিক ৮৯ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। সে হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া পুরো টাকাটাই দেশের মানি সার্কুলেশনে এসেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার টার্গেট ঠিক করেছিল সরকার। জানুয়ারি শেষে সরকার এই টার্গেটের ৩২ দশমিক ৫৩ শতাংশ ঋণ নিয়েছে এই খাত থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১ বছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে মোট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা। রীতিমতো এর পুরোটাই সরকার নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
সবমিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ০৫ লাখ কোটি টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, সরকার ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। ঋণের অধিকাংশই বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় হয়। চলতি অর্থবছরে নন-ব্যাংকিং খাত থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। এরমধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিএফআইসহ অন্যান্য খাত থেকে ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এনবিএফআইসহ অন্যান্য খাত থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সঞ্চয়পত্রের ঋণ বাড়ার বদলে উল্টো কমেছে ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানীতে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৪০ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এবং আগের ঋণের ৪৩ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।