থাক তাহলে, মেট্রোরেলের দরকার নেই!

0

Metro-rail-on-trackগত বছর সিঙ্গাপুরে গিয়ে দেখলাম, নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে রেল সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুর খুব ছোট একটি দেশ, সিটি স্টেট বলা হয় যাকে। যোগাযোগব্যবস্থা এমনিতেই অনেক উন্নত। আর বাস যোগাযোগ এতই সুবিধাজনক যে মনেই হয় না, নিজের একটা গাড়ি থাকা খুব জরুরি। তার পরও দেখলাম, সিঙ্গাপুরের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেন সার্ভিস নিয়ে ছাত্রদের কত উচ্ছ্বাস! আমার বর বলছিল, রেলস্টেশন হয়ে গেলে আমরা খুব সহজে বুন লে যেতে পারব। এমনকি আমাদের দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেন সার্ভিস খুবই জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম থেকেও তো ছাত্ররা ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় ক্লাস করতে। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেল নিয়ে কেন এত আন্দোলন, সেটা তো বুঝতে পারছি না!

বাংলাদেশে তো আন্দোলনের জন্য ইস্যুর অভাব আছে বলে মনে হয় না! কেউ কেউ অবশ্য বলতে পারেন, এসব ভ্রমণ কাহিনী দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে মেট্রোরেল বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলার জোরালো কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আমি বলব, মেট্রোরেল জিনিসটাই ব্যবহার হয় ভ্রমণের জন্য। কাজেই এ বিষয়ে কেউ লিখলে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখলে, তা ভ্রমণ কাহিনীই হওয়ার কথা। তবে সত্যিই যদি কেউ যুক্তি শুনতে চায়, তা কিন্তু ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যেই খুঁজে নেওয়া যায়।

এখন আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়েই এই ট্রেন চলতে হবে, তার সঠিক কারিগরি দিকটি আমি জানি না। আমি শুধু বলতে চাইছি, এটা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে বা পাশ দিয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা স্টপেজ থাকে, তাতে অসুবিধা কোথায়? আমি তো দেখি সুবিধাই বেশি; বরং দূর থেকে আসা শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাথীদের পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা দিতে পারে না। প্রচুর শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে জায়গা না পেয়ে ব্যয়বহুল প্রাইভেট হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। আবার কেউ কেউ প্রাইভেট হোস্টেলের টাকা জোগান দিতে না পেরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারগুলোর বাসাতে একটি রুম ভাড়া নিয়ে চার-পাঁচজন একই রুমে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এসব বাসায় শিক্ষার্থীরা যে কী পরিমাণ মানবেতর জীবনযাপন করছে, তা কাছ থেকে না দেখলে চিন্তাই করা যাবে না। ভাড়াও কিন্তু কিছু কম নয়। আর অন্যের বাসায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে যারা থাকছে, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু খুব ঝুঁকিপূর্ণ।

কাজেই মেট্রোরেল হলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা স্টপেজ থাকলে, ঢাকার আশপাশের শিক্ষার্থীদের আবাসন নিয়ে কোনো চিন্তা করার দরকার হয় না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই তারা বাসা থেকে অনায়াসে মেট্রোরেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে পারে।

আর এমনও নয় যে, রাজশাহী বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি গণ্ডি আছে, যার ভেতর দিয়ে কোনো গণপরিবহন যেতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাস তো ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যেমন নিউমার্কেটের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের যে আবাসিক হল বা ইনস্টিটিউট আছে, গ্রিন রোড এলাকায় যে আবাসিক হল আছে, সেগুলোর কী হবে? সেসব আবাসিক হল বা ইনস্টিটিউটের পাশ দিয়ে তো গণপরিবহন যাচ্ছে। তাহলে মেট্রোরেল নিয়ে আপত্তি কেন? একটুও অবাক হবো না, যদি কিছুদিন পর দেখি উত্তরা বা বনানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউট বা আবাসিক হল বানানো হচ্ছে। অনেকেই বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে মেট্রোরেল গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ বাড়বে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ নেই? আমার মনে হয়, নতুন কিছু হলে এমন হাজারটা আশঙ্কা তৈরি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধের জন্য আরো আগেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করা উচিত ছিল, যা শিক্ষার্থীরা এত বছরেও পারে নাই। তাহলে এখন কেন মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবি উঠছে?

শুধু মেট্রোরেলের বেলাতেই কেন এত আন্দোলন! পদ্মা সেতু প্রকল্পে গিয়ে দেখে আসুন। সেতু নির্মাণের জন্য কত মানুষকে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তার পরও কেউ পদ্মা সেতুর বিরোধিতা করেছে বলে শুনিনি। পদ্মাপাড়ের লোকেরা চেয়েছে, সে অঞ্চলের উন্নতি। তারা গরিব, অসহায় অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রি নেয়নি বলেই কি আমরা তাদের ত্যাগ নিয়ে ভাবি না? বাস্তবতা হলো, নতুন করে কিছু স্থাপন করতে চাইলে কাউকে না কাউকে, কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়। তা না পারলে, সরাসরি বলে দেওয়াই ভালো যে, ‘আমরা মেট্রোরেল চাই না।’

মেট্রোরেল নিয়ে প্রথম আপত্তি শুনেছিলাম যে, এটি সংসদ ভবন এলাকার ভেতর দিয়ে গেলে লুই কানের করা নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন আপত্তি শুনছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়া নিয়ে। আমি নিশ্চিত, এই সংকট সমাধান হলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেলের বিপক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিলেও মেট্রোরেলের রুট নিয়ে নতুন নতুন আপত্তি উঠতেই থাকবে। কারণ, ঢাকা কোনো পরিকল্পিত নগরী নয়। ঢাকায় কখনো মেট্রোরেল হবে, তেমন পরিকল্পনাও ছিল না। কাজেই এখন যদি মেট্রোরেল বাস্তবায়ন হয়, তা কোনো না কোনো স্থাপনার ওপর দিয়েই যাবে। থাক তাহলে, কী দরকার এত ঝামেলা বাড়িয়ে মেট্রোরেল করার! তারচেয়ে বরং আমরা মাঝেমধ্যে বিদেশে বেড়াতে যাবো, ছবি তুলে ফেসবুকে দেব আর দেশে এসে বিদেশের উন্নয়ন আর অবকাঠামো নিয়ে কথা বলব।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More