ভিন্নমতের কারণে নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের শাস্তি কি হল ছাড়ার নির্দেশ?

0

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচজনকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার (২৭শে ফেব্রুয়ারি) সভা করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

প্রশ্ন উঠেছে, একজন ছাত্রীকে নির্যাতনের পর দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি বা হল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই কি চুড়ান্ত শাস্তি। জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রুম দখলে নিয়ে সীট বাণিজ্য এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ভিন্নমতের ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলা, বিবস্ত্র করে ভিডিও করার ঘটনায় শাস্তির জন্য দেশে কি কোন আইন নেই? ছাত্রলীগ করলেই কি তারা এই আইনের উর্ধ্বে থাকেন?

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে সাময়িক বহিষ্কার বা হল ছাড়ার নির্দেশ দেখা যায়। কিন্তু তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কোন রকমের প্রতিকার বা শাস্তি হতে দেখা যায় না।

উল্লেখ্য, ইবি শাখা ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী ফুলপরী। ঘটনাটি দেশব্যাপী সমালোচনার জন্ম দিলে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

এছাড়া ওই ঘটনায়, বিশ্ববিদ্যালয়, হল প্রশাসন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

এসব কমিটির ডাকে গত ১৮, ২০ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে এসে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভুক্তভোগী ফুলপরী। ওইসব দিনে ক্যাম্পাসের ভিতরে নিরাপত্তা দেয় প্রক্টরিয়াল টিম।

উল্লেখ্য, গত ১২ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রী হলে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতন করা হয়।

নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল জঙ্গি ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসীরা।

ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী ১৪ই ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করে।

ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসী সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। নির্যাতনকাণ্ডে তার সঙ্গী তাবাসসুম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীও একই বিভাগের।

ভুক্তভোগী ছাত্রী গণমাধ্যমকে জানান, গত ৮ই ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে থাকেন। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে থাকেন। এ সময় ওই ছাত্রী হাত তোলেন। হলে ওঠার বিষয়টি আগে তাবাসসুমকে না জানানোয় মারাত্মক রেগে যান তিনি। এরপর তাঁকে হলের কক্ষে (প্রজাপতি-২) দেখা করতে বলেন। তবে অসুস্থ থাকায় দেখা করেননি তিনি। ১১ই ফেব্রুয়ারি ক্লাসে গেলে তাঁকে বকাঝকা করেন তাবাসসুম।

নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন, এই ঘটনার জেরে ১২ই ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে হলের গণরুমে (দোয়েল) তাঁকে ডেকে নেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল তাঁকে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন করেন।

জঙ্গি ছাত্রলীগের নেত্রীর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে চালাচ্ছিল শারীরিক নির্যাতন। কিল, ঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল।

তিনি বলেন, নির্যাতনের সময় আরেক ছাত্রী মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করেন। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তাঁরা কোনো কথা শোনেননি। গণরুমে এ সময় উপস্থিত সাধারণ ছাত্রীরাও কোনো কথা বলেননি।

ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয় এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এমনকি প্রভোস্টের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয় লিখে দিয়ে আমাকে বলেছে, হাসবি আর এগুলা বলবি। সব তারা ভিডিও করে রেখেছে। আপুরা মারার সময় বলছিল “মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।”’

রাতের কথা কাউকে জানালে ওই ছাত্রীরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী আরও বলেন, এ কথা কাউকে বললে হল থেকে বের করে দেবে বলে শাসায়। এই কথা বাইরে গেলে ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। তাঁরা বলে, তুই হলের প্রভোস্ট স্যারকে বলবি, সব আমার দোষ, এই হলে থাকব না। এসব বলে হল থেকে একেবারে চলে যাবি। এই কথা ১৪ তারিখ বলবি।

ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি, কেউ কোনো কথা শোনেনি। রাত সাড়ে তিনটার পর তাঁরা চলে যায়। আমি গণরুমেই ছিলাম। এরপর সকাল নয়টার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে থেকে বাসে উঠে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। আমার শরীর ব্যথা। জ্বর অনুভব করছি। ঠিকমতো খেতে পারছি না। গালের ভেতর সামান্য কেটে গেছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। যাঁরা জড়িত, প্রত্যেকের শাস্তি চাই।

এ ঘটনায় রিট হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।

ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গতকাল রোববার জমা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুন্সি কামরুল হাসানকে আহ্বায়ক করে দুই সহসভাপতি বনি আমিন ও রাকিবুল ইসলাম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেনকে কমিটির সদস্য করা হয়। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। ছাত্রলীগ তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ফুলপরীকে নির্যাতনের সত্যতা পাওয়া গেছে।

উৎসঃ   আমার দেশ
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More