ঢাবির ছাত্রলীগ নেত্রী ও রহস্যময় যুবক, অতঃপর…

0

file1রাত তখন সাড়ে ১১টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবেমাত্র রাতের রেশ এসেছে। হালকা শীত আর কনকনে বাতাসে শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সামনে আচমকা একটি এক্স করোলা প্রাইভেট কার এসে থামে। গাড়ি নম্বর-ঢাকা মেট্রো ১২-৯৫৫৯। কারের ভেতরে ড্রাইভারসহ আরো দুইজন অবস্থান করছিল। স্বাভাবিকভাবে ছাত্রীদের হল গেইট রাত সাড়ে ৯টার দিকে বন্ধ হয়ে যায়। পরে আর খোলা না হলেও ওইদিন দেখা গেল অন্য দৃশ্য।
দুই মিনিটের মধ্যেই হলের সব বিধি নিষেধ অমান্য করে গেইট খুলে বের হয়ে আসেন ঢাবির হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশিতা ইকবাল নদী। কারের কাছে এসে ভেতরে অবস্থান করা লোকদের সাথে কথা বলতে থাকেন ওই নেত্রী।

ঠিক এর কয়েক মিনিট পরেই সেখানে তিনটি মোটরবাইক এসে উপস্থিত হয়। তিনজন লোক বাইক থেকে নামে। এসময় সেখানে আরো ১০-১২ জন অচেনা যুবক এসে উপস্থিত হয়। কারের ভেতরে অবস্থান করা মানুষটিকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে মারধর করতে থাকেন বাইকের ওই তিনজন এবং অচনো যুবকেরা।
শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সামনে এ নাটকীয় ও রহস্যময় ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সূত্রে জানা যায়, নদীকে ইভটিজিং করেছিল। যার কারণে কয়েকজন মিলে তাকে মারধর করে ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে নদী বলেন, তারা মূলত টিজ করেনি। তারা একটা প্রতারক। তাই তাকে মারধর করা হয়েছে।
নদীর সাথে ফোনালাপে জানা যায়, রাত ১১টার দিকে জাদু গোপাল দে নামের একজন লোক নিজেকে ‘এটিএন নিউজ’ এর সাংবাদিক পরিচয় দেয়। তিনি বিভিন্ন সময় আমাকে ফোন দিয়ে আমার বিরুদ্ধে পত্র পত্রিকায় হওয়া বিভিন্ন রিপোর্ট নিয়ে কথা বলেন।
নদী বলেন, তিনি আমার বিরুদ্ধে হওয়া বিভিন্ন রিপোর্টগুলো কৌশলে আটকে দেন বলে আমাকে জানান। এছাড়া তিনি নিজেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কথাও জানান এবং সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে তার গভীর সম্পর্কের কথা বলে ভবিষ্যতে কমিটিতে তার পদ দেবেন বলেও উল্লেখ করেন।
এছাড়া তিনি জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগ নেতা আসিফ তালুকদার, বঙ্গবন্ধু হলের রেজা, বুয়েট আহসানুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শুভ্রসহ বিভিন্ন ছাত্রলীগ নেতাদেরকে কাছে ফোন দিয়ে তাদেরকে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে অনেক টাকা দাবি করে। যার কারণে তারা প্লান করে এখানে নিয়ে এসে মারধর করে। তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গোলাম রাব্বানীও ছিলেন বলে নদী জানান।
তাদের সমস্যায় তার (নদী) সেখানে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে যেহেতু একজন ক্রাইম রিপোর্টার এতবড় সাংবাদিক। তাকে একটু চিনে রাখা ভালো না?
জানা যায়, ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও কোন ব্যাবস্থা নেননি। এছাড়া হরতাল-অবরোধে যেকোন ধরনের নাশকতা এড়াতে এসময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা থাকলেও তাদের চোখে পড়েনি বিষয়টি!
এদিকে বাইকে করে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরও কারটি ঘটনাস্থলে পড়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়। পরে তিনজন অজ্ঞাতানামা লোক এসে সেটিও নিয়ে যায়। কারটি ক্যাস্পাস নীলক্ষেত মোড়ে আসলে পুলিশ আটক করে দিলেও পরে ওই নেত্রীর নাম বলাতে ছেড়ে দেয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শাহবাগ থানায় কর্তব্যরত এক পুলিশ বিষয়টি স্বীকার করলেও পরে অস্বীকার করেন। এদিকে নদী রাত ১টার পর হলে ফিরে বলে হলসূত্রে জানা যায়। কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। এছাড়া নদীর বিরুদ্ধে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। হলের ছাত্রলীগের সম্পাদক পর্যায়ের আরেক নেত্রী এ অভিযোগ তোলেন।
বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. এম আমজাদ আলী। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়েছে অভিযুক্ত হল প্রাধ্যক্ষা সাজেদা বানুকে। যার বিরুদ্ধে এর আগে নদীর ব্যাপারে দেওয়া বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানা যায়।
এছাড়া বিভিন্ন সময় নানা অপকর্মের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের ওই নেত্রীর বিরুদ্ধে। কেউ তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দিলে বা কথা বললেই তাকে শারীরিক নির্যাতন ও জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়া হয় এমন অভিযোগও উঠেছে ওই নেত্রীর বিরুদ্ধে।
জানা যায়, গত কয়েক মাস আগে হলে কর্তব্যরত রুমী পারভীন নামের এক ডাক্তারের ওপর অমানবিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেন ছাত্রলীগের ওই নেত্রী। আর এক্ষেত্রে হল প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বিপরীতে ওই ডাক্তারকে দোষী করে। পরে প্রক্টরকে সঙ্গে নিয়ে নদী শাহবাগ থানায় অভিযোগ দিয়ে আসে।
যার কারণে থানায় কোন মামলা দায়ের করতে পারেনি ভুক্তোভোগী ওই ডাক্তার। ওই দিন সারারাত তিনি থানায় ছিলেন বলে জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে সব আস্থা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান ওই ডাক্তার।
নদী হলের শিক্ষার্থীদেরকে অনৈতিক কাজে জড়ানোর জন্য বাধ্য করে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ তোলেন হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কেউ তার বিরুদ্ধে কোন কথা বললে তাকে মেরে হল থেকে বের করে দেন বলে একাধিক ছাত্রী জানিয়েছে।
গত বছর জয়িতা ও জোতি নামের দুই শিক্ষার্থীকে মেরে হল থেকে বের করে দেন ওই নেত্রী। এছাড়া কিছুদিন আগে গভীর রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া অবস্থায় মসজিদ ঘর থেকে তিন মেয়েকে ধরে রাতভর নির্যাতন করেন ওই নেত্রী। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদেরকে ‘হিজবুত তাহরীর’ অভিযোগ দিয়ে হল থেকে বের করে দেন।
সম্প্রতি তার কথা না শোনায় হল শাখা ছাত্রলীগের এক নেত্রীকে নির্মমভাবে মারধর করে হল ছাড়া করে ওই নেত্রী। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী ওই নেত্রী গত বৃহস্পতিবার শারীরিক নির্যাতন ও হল থেকে বের করার প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। নির্যাতনের স্বীকার ওই নেত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে একটি বিভাগে দ্বিতীয়বর্ষে অধ্যয়নরত।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে নদী বলেন, ওই মেয়ে হলে প্রকাশ্য মদ পান থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে নানা অপকর্ম করত। গত বছর পহেলা বৈশাখে চারুকলায় এক ছেলের সাথে আসামাজিক কর্মকাণ্ডে করতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়েছিল। তাই একজনের জন্য কেন ছাত্রলীগ এবং হলের অন্য মেয়ের বদনাম হবে? তাই তার চারিত্রিক সমস্যার কারণে হল প্রশাসনের সাথে কথা বলে তার সিট বাতিল করার ব্যবস্থা করছি।
বিষয়টি জানতে হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সাজেদা বানুকে বারবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ বলেন, আমি ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। আমি যতটুকু জানি সেখানে কিছু যুবক তাকে ইভটিজিং করে। প্রতিবাদে কয়েকজন মিলে তাকে মারধর করে।
এ ছাড়া মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাধ্যক্ষ এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা বলেন, ‘একটি মেয়েকে কেন শুধু শুধু দোষী করা হচ্ছে বুঝি না। সে একজন ভুয়া সাংবাদিক। তাকে মেরে ছেলেরা ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’
এছাড়া মাদকের বিষয় তিনি বলেন, সোনালী নামের যে মেয়েটি এ অভিযোগ করেন আমি তাকে চিনি না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More