পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয় না বিএনপিতে

0

BNPপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর ওয়ান-ইলেভেনের ধকল সাময়িকভাবে সামলে নিলেও দলটি এরপর থেকে রাজনৈতিকভাবে একের পর এক বিপর্যয়ের মধ্যেই সময় পার করছে। ক্ষমতার বাইরে বিগত আট বছরে রাজনৈতিক বিপর্যয় কাটাতে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিএনপি। কিন্তু কোনো পরিকল্পনা ও কর্মসূচিই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন বা সফল হয়নি। দলের নেতাকর্মীরাই এমনটা মনে করেন। তাদের মতে, দলের কর্মপন্থা সঠিকভাবে নির্ধারণ করে বাস্তবায়ন করতে পারলে এত জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপিকে এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। বিশেষ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির কর্মকৌশল, পরবর্তী সময়ে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট করে লাগাতার হরতাল-অবরোধের আন্দোলন।
জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন। দলটির পরিকল্পনা ছিল ঢাকায় ব্যাপক লোকসমাগম করে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা।  ওই দিন সরকারের কঠোর পদক্ষেপের মুখে বাসা থেকেই বের হতে পারেননি খালেদা জিয়া। বিএনপির শীর্ষ নেতারাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমে আসেননি। তখন বিএনপি সারাদেশে দেড়মাসের বেশি সময় লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি চালিয়েও সফলতা পায়নি। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছর পূর্তির দিনে বিএনপি আবারো ঢাকার নয়াপল্টনে সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু সরকারের কঠোর পদক্ষেপের মধ্যে রাস্তায় নামতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকেই তিনি সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের হরতাল-অবরোধের ডাক দেন। প্রায় দুই মাসের বেশি সময় হরতাল-অবরোধ চালিয়েও আবারো সরকার হটাতে অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায় করতে পারেনি। উল্টো মামলার জালে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা হয়রানির মধ্যে পড়েছেন। মামলা ও কারাগার মিলিয়ে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।
আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে সরকারের কঠোরতার চেয়ে দলের নেতাদের স্বার্থপরতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন বিএনপির নেতাকর্মীরাই। তাদের অভিযোগ আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা নেতারা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করার কারণেই সারাদেশে কঠোর আন্দোলন হলেও ঢাকায় আন্দোলন জমেনি। ঢাকায় আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে খালেদা জিয়া মহানগর কমিটিও পুনর্গঠন করেছেন। দীর্ঘদিন ঢাকা মহানগরের দায়িত্বে থাকা সাদেক হোসেন খোকা ও আবদুস সালামকে সরিয়ে মির্জা আব্বাস এবং হাবিব উন নবী খান সোহেলকে দায়িত্ব দেন। নতুন কমিটিও আন্দোলন-সংগ্রামে খুব একটা ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ঢাকা মহানগরের নতুন কমিটি গঠনের পর নেতাকর্মীদের মনে যতটা আশার সঞ্চার হয়েছিল আন্দোলনে তাদের ভূমিকায় ততটাই হতাশ হয়েছেন। আজ পর্যন্ত মির্জা আব্বাস-সোহেল মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও গঠন করতে পারেননি। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি পরিবর্তন করেও খুব একটা লাভ হয়নি। বরং নতুন কমিটি নিয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা নিজেরাই মারামারিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ছাত্রদলও রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়তে পারেনি। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক, মহিলাদলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও নিজেদের বাঁচিয়ে চলেছেন।
একপর্যায়ে গত বছর মার্চে আন্দোলনে বিরতি দিয়ে বিএনপি ঢাকা, চট্টগ্রাম তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের দাপটে মাঠে নামতে পারেনি। নির্বাচনের দিন ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন বয়কট করে। নির্বাচন বয়কট করেও নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যায়নি। এরপর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সংগঠন গোছানোর ঘোষণা দেন। প্রায় দুই বছর হতে চললেও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার পরিকল্পনাও খুব বেশিদূর এগোয়নি। গত বছর সেপ্টেম্বরে খালেদা জিয়ার লন্ডনে সফরের মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পুনর্গঠনের যে আলোচনা শুরু হয়েছিল তা পৌরসভা নির্বাচনের ডামাডোলে চাপা পড়ে যায়। দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিএনপির পরিকল্পনাও সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও বিএনপি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে। বিএনপি নেতারা অবশ্য বলছেন, ফলাফল তাদের অনুকূলে না থাকলেও পৌরসভা নির্বাচনের মাধ্যমে সারাদেশের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়েছেন।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় গুলশান কার্যালয়ের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ অনেকদিনের। বিভিন্ন সময় বিএনপির শীর্ষ নেতারাও এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হাইকমান্ডের কাছেও অভিযোগ করেছেন। গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে রদবদলের উদ্যোগও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। পুরাতন কর্মকর্তারাই বহাল তবিয়তে দায়িত্বে রয়েছেন। সহ-দফতরের এক-দুজন নেতাকে গুলশানে বাড়তি দায়িত্ব দেয়া ছাড়া সবকিছুই আগের মতোই চলছে।
পৌরসভা নির্বাচন শেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন সরকারের দু’বছর পূর্তি হলেও বিএনপি রাজধানীতে সমাবেশ ছাড়া তেমন কোনো কর্মসূচি দেয়নি। এ মুহূর্তে বিএনপির সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হলো দল পুনর্গঠন। দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করা। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে বিএনপি একাধিকবার কাউন্সিল করার উদ্যোগ নিলেও বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা করতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দিয়েই চলছে দলের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজ। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর থেকেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য শারীরিকভাবে অসুস্থ। দু’জন মারা গেছেন। নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাবাদী নেতাদের বাদ দিয়ে দ্রুত দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের দাবি উঠছে বিএনপির ভেতর থেকেই। এমন অবস্থায় বিএনপির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও দল পনুর্গঠনের তাগিদ এসেছে। জানা গেছে, মার্চের মধ্যে বিএনপির কাউন্সিল করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখন দেখার বিষয় দল পুনর্গঠনের পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার কথা বলে আসছেন। ২০ দলীয় জোটের বাইরে আসম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বিকল্পধারা বাংলাদেশসহ বাম কয়েকটি দলের সঙ্গেও কয়েকদফা বৈঠক-আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই উদ্যোগও সফলতা পায়নি। জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রয়াস ভাষণ আর বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। তবে বিএনপির সব পরিকল্পনা সঠিকভাবে কাজ করেনি তা মানতে নারাজ দলের নীতি নির্ধারকরা। স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহাবুবুর রহমান মানবকণ্ঠকে বলেন, আমাদের আন্দোলনের কর্মকৌশলে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। কোনো রাজনৈতিক দলের সব কর্মকাণ্ড সমানভাবে সফল হয় না। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করছি। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সেই আন্দোলন সফল হবে। দেশে গণতন্ত্র ফিরবে। মানুষ তাদের ভোটের অধিকারও ফিরে পাবে। সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশে একটি জাতীয় নির্বাচন আদায়ে বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে পার্শ্ববর্তী ভারত সরকারেরর সমর্থন আদায়ের জোর চেষ্টা চালায়। কূটনীতিক উদ্যোগের ফলস্বরূপ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ২০১২ সালে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে প্রথমবারের মতো ভারত সফর করেন। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ কংগ্রেস ও বিজেপির অনেক নেতার সঙ্গেই খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ ও বৈঠক হয়। খালেদা জিয়াও ভারত সরকারকে আস্থায় নেয়ার জোর চেষ্টা চালান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বিএনপি চেয়ারপার্সন আশ্বস্ত করেছিলেন বিএনপি ক্ষমতায় এলেও বাংলাদেশের মাটি ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। খালেদা জিয়ার ভারত সফরের মাধ্যমে তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয়। কিন্তু এখানেও কূটনৈতিক ব্যর্থতায় বিএনপি তা ধরে রাখতে পারেনি। জামায়াত ইসলামীর হরতাল থাকার কারণে খালেদা জিয়া ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার ইস্যুতে বিএনপি নেতারা নাখোশ। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বে ভারত সরকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিএনপির জোরদার সম্পর্ক থাকলেও তারাও প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদের ওপর তেমন চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক নতুন করে বিএনপির মধ্যে আশার সঞ্চার করে। নরেন্দ্র মোদি খালেদা জিয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও একান্ত বৈঠক করেছেন। বৈঠকে খালেদা জিয়া বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভারত সরকারের সহযোগিতা চান। জানা গেছে, নরেন্দ্র মোদির সরকারের সঙ্গে বিএনপি সম্পর্ক জোরদারে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। মাসখানেক আগেই চার সদস্যের বিএনপির একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল দিল্লি সফর করে এসেছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক হয়েছে। বিএনপি সম্পর্ক জোরদারে এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে। বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা মানবকণ্ঠকে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মপন্থাসহ কূটনৈতিক চিন্তাভাবনাও নতুন করে সাজাতে হবে।
এদিকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে আজ আবারো দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। গুলশান কার্যালয়ে রাত সাড়ে ৮টায় বৈঠক শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। জানা গেছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা করে এই বৈঠক থেকেই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সময়সূচি ও প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হতে পারে। এ ছাড়া নতুন নির্বাচন আদায়ের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। f

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More