স্কুল ব্যাংকিং : একটি সফল উদ্যোগ

0

school bangkingবিশ্বের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক। আর্থিক লেনদেনকে সহজ ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে শুরু হয় ব্যাংকিং কার্যক্রম। ব্যাংক মানুষকে অধিক সঞ্চয়ী হতে উদ্বু^দ্ধ করে থাকে। মানুষের বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করাই ব্যাংকের অন্যতম কাজ। এই ক্ষুদ্র অর্থ একসময় পরিণত হয় বড় অঙ্কে। বিনিয়োগ করা হয় উৎপাদনশীল কাজে। এসব কার্যক্রম থেকে যে মুনাফা আসে তারই একটি অংশ দেয়া হয় সঞ্চয়কারীকে। এতে ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। মানুষ তার কষ্টার্জিত অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য ব্যাংকে সংরক্ষণ করে। শুধু অর্থ নয়, মূল্যবান অলংকারাদিও ওখানে রাখা হয়। ব্যাংকিং সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ব্যাংক নানা প্রকার কর্মসূচি বা সেবা প্রদান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকিং কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে এটিএম, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো সেবা পদ্ধতি যা মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ ও গঠনমুখী করে তুলেছে। লেনদেনে ঝুঁকির পাশাপাশি জাল-জালিয়াতিও কমেছে। মানুষ ঘরে বসেই ব্যাংকের সুযোগ সুবিধা নিতে পারছে। দিন দিন ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রতি মানুষের আস্থা-আগ্রহও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যাংক শুধু অর্থ সঞ্চয় ও সংগঠিত করে না। বেকারত্ব দূরীকরণেও রয়েছে ব্যাংকের অগ্রণী ভূমিকা। তাছাড়া ব্যাংক যেসব জায়গায় বিনিয়োগ করে থাকে সেখানে নতুন কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ব্যাংক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। এটাকে কাজে লাগিয়ে ঋণ গ্রহীতা নিজ উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দিতে পারেন। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের অধিকসংখ্যক মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। এখনো বেশিরভাগ কৃষক দারিদ্র্যসীমার মধ্যে রয়েছে। ফলে অর্থাভাবে সময়মতো বীজ বপন, সেচ, সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারেন না। এতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হন কৃষকরা। ব্যাংক এসব দরিদ্র কৃষককে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে কৃষি কর্মেও আগ্রহী করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চাকরিজীবীরাও ব্যাংকগুলোর ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। ১৮ বছরের বেশি বয়সের অর্থাৎ সাবালক ছাত্রছাত্রীদেরও বর্তমানে কিছু ব্যাংক শিক্ষাঋণ দিচ্ছে যা শিক্ষা কার্যক্রমে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। ব্যাংকিং কার্যক্রমে এতদিন সর্ব সাধারণ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশুরা। এই শিশুদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ‘স্কুল ব্যাংকিং’ নতুন সেবা কার্যক্রম চালু হয়েছে। এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের একটি বিষয়। এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশুদের অর্থাৎ স্কুলগামী শিশুদের। সংযুক্ত করা হয়েছে পথশিশুদেরও। এরই মধ্যে দেশের প্রায় ব্যাংকই এই ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু করেছে।
স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের সঞ্চয়ে আগ্রহী করতে ২০১০ সালে দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে স্কুল ব্যাংকিং সেবা চালু করার পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই আলোকে বিদ্যালয়গামী শিশুদের জন্য চালু করা হয় আকর্ষণীয় মুনাফাসহ বিভিন্ন স্কিম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বর্তমানে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ। গত জুন শেষে এ সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৫২ হাজার। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে ক্ষুদে সঞ্চয়ীদের মোট জমার পরিমাণ প্রায় ৮শ’ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম এমন একটি কার্যক্রম যেখানে ছাত্রছাত্রীরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারবে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে জমাকৃত অর্থ লভ্যাংশসহ উত্তোলন করতে পারবে। আগে শিশুরা মাটির ব্যাংকে টাকা জমা রাখত। স্কুল ব্যাংকিং শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি বা অবিশ্বাস থেকে বের করে এনে একটা নিরাপদ ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। হিসাবী এবং সঞ্চয়ী জাতিই কেবল সচ্ছলতা লাভ করতে পারে। শিশুরা ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাই শিশুকাল থেকেই তাদের মধ্যে সঞ্চয়ী হওয়ার প্রবণতা তৈরি করতে হবে।
আমাদের দেশে স্কুল ব্যাংকিং ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর ফলস্বরূপ চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশানাল (সিওয়াইএফআই) প্রদত্ত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’ অর্জন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম বিশেষ করে শিশুদের আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং স্কুল ব্যাংকিংয়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। ভারত ও ফিজিকে পেছনে ফেলে আমাদের দেশ এই পুরস্কার লাভ করেছে। আর্থিক শিক্ষা কর্মসূচিতে অবদান রাখার জন্য ২০১৪ সালে এ অঞ্চল থেকে সিঙ্গাপুরকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল’ ইউরোপের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান। আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সারা বিশ্বের ১২৫টি দেশের ৩ কোটি শিশু ও যুবককে নিয়ে কাজ করে। তারা বৃহৎ পরিসরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অবদান রাখার জন্য ব্যক্তি, সরকারি সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সুধী সমাজের সংগঠনকে পুরস্কৃত করে থাকে। পুরস্কার প্রদানের সময় শিশুদের ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। দেশের সব শিশুকে এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরো শক্তিশালী হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More