গভীর সংকটের মুখে পোশাক শিল্প>> কমে যাচ্ছে নতুন অর্ডার

গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব চরম ভোগাচ্ছে * উৎপাদন খরচ বাড়ায় সক্ষমতা কমছে * ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত

0

করোনাপরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বের অর্থনীতির চিত্র বদলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো মূল্যস্ফীতির মোকাবিলায় কৃচ্ছ সাধনের পথে হাঁটছে।

সেই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে। একদিকে ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে, এমনকি আগের দেওয়া অর্ডারও নিচ্ছে না। অন্যদিকে পোশাকের দাম কমাতে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে।

তার ওপর গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিতে শিল্প মালিকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। আর ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে গড়িমসি করছে। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে পোশাক শিল্প।

একাধিক শিল্প মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে পোশাক শিল্প চরম সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আন্দাজ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল দিয়েও পোশাক বিক্রি বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কারণে বিদেশি ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে চাচ্ছে না। এমনকি পুরোনো যেসব অর্ডার উৎপাদন শেষে শিপমেন্টের অপেক্ষায় আছে, সেগুলোও তারা নিতে চাচ্ছে না। ওয়্যারহাউজে সেসব পণ্য পড়ে আছে। ডেফার্ড পেমেন্টে সেসব পণ্য নেয়ার অনুরোধ জানালেও তাতে সাড়া দিচ্ছে না।

তারা আরও বলেন, অর্ডার না আসার আরেকটি কারণ গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট। দিনের বেশির ভাগ সময় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ থাকছে না। লোডশেডিংয়ের শিডিউলে বিপর্যয় নেমে এসেছে। কখন, কতক্ষণ লোডশেডিং হবে তা কেউ বলতে পারছে না। সব মিলিয়ে সামনের দিনে জ্বালানি পরিস্থিতি ক্রেতাদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিদেশি ক্রেতারাও জ্বালানি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। জ্বালানি সংকটের কারণে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবো কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে ক্রেতাদের মাঝে।

সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকার কারখানাগুলোতে দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। অনেকে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বড় কারখানাগুলোয় দৈনিক গড়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ডিজেল লাগছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে টেক্সটাইল মিলগুলোতে অনেক আগে থেকেই গ্যাস সংকট রয়েছে। দিনের বেশিরভাগ সময় চাপ থাকছে না। ঘন ঘন লোডশেডিং ও গ্যাসের চাপ ওঠানামার কারণে কারখানার যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে।

অবস্থা এমনই বেগতিক যে, একদিকে অর্ডার নেই, অন্যদিকে দর কমাতে ক্রেতারা চাপ দিচ্ছে। অর্ডার দিলেও গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহণ খরচের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অর্ডার নেওয়াও যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে এখন শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথাও ভাবছেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) বলছে, আগে যেখানে এক কেজি সুতা উৎপাদনে এক ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হতো, এখন সেখানে ২ ডলারের বেশি খরচ হচ্ছে। গ্যাস সংকটে ৬০ ভাগ টেক্সটাইল মিল বন্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে। কোথাও কোথাও দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। আবার গ্যাস থাকলেও চাপ থাকে না। এতে সুতা উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে পড়ছে বিধায় প্রতিযোগী সক্ষমতায় টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিলে এ অবস্থা তৈরি হতো না। দ্রুত সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে না পারলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, এখন টেক্সটাইল শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ জ্বালানি সংকট। দেশে গ্যাসই একমাত্র শিল্পের কাঁচামাল। বাকি সবকিছুই আমদানি করতে হয়। জ্বালানি সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না হলে পুরো বস্ত্রখাতে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় শিল্প ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছিল। সেই প্যাকেজের ৮০ ভাগ টাকাই পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও করোনাকালীন সময়ের মতো ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট দরকার। খোকন আরও বলেন, ডলার সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে বস্ত্র খাত। এ খাতে এক মিলিয়ন ডলারের গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে ২০ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।

বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আন্তর্জাতিক ও দেশিয় চতুর্মুখী চাপে পড়েছে পোশাক শিল্প। বিশ্বমন্দার কারণে অর্ডার কমে গেছে। বিদেশিদের কাছ থেকে অর্ডার আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে অর্ডার নিতে পারছি না। এ কারণে বিদেশি ক্রেতারাও অর্ডার দিতে সংকোচবোধ করছে। তার ওপর বন্ড-কাস্টমসের ঝামেলা তো আছেই।

তিনি আরও বলেন, সরকার এই শিল্পকে পলিসি সহায়তা দেওয়ায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ সাপোর্ট না দিলে শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে তা বলা মুশকিল।

শিল্পের স্বার্থে বাসা-বাড়ি এবং গাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তিতাসের হিসাবেই বাসা-বাড়িতে সবচেয়ে বেশি গ্যাসের অবৈধ লাইন রয়েছে। আর সেই চুরির দায় চাপছে শিল্প মালিকদের ওপর। যেহেতু বাসা-বাড়িতে গ্যাসের বিকল্প এলপিজি আছে, তাই এখনই শিল্পের স্বার্থে বাসা-বাড়িতে গ্যাস বন্ধ করে শিল্পে সরবরাহ করা উচিত। এতে অর্থনীতি চাঙা হবে, যার সুফল সবাই পাবে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বৈশ্বিক মন্দার মতো আন্তর্জাতিক সংকট সমাধানে আমরা চাইলেও করতে পারব না।

কিন্তু দেশে সংকটগুলো যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি এবং ব্যবসা সহজীকরণের মতো পদক্ষেপগুলো নিতে পারি। স্থানীয় সংকটগুলো মোকাবিলা করা গেলে শিল্পের সক্ষমতা বাড়বে।
jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More