বিনিয়োগে প্রণোদনা, সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে শিল্প প্রতিষ্ঠা, বিদেশি বিনিয়োগ, পরিবেশবান্ধব শিল্প ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নতুন জাতীয় শিল্পনীতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। আগামী বুধবার অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে জাতীয় শিল্পনীতি উপস্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নতুন শিল্পনীতিতে উচ্চ অগ্রাধিকার খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প, আইসিটি, সফটওয়্যার শিল্প, ওষুধ শিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ও পাট ও পাটজাত শিল্প।
অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্পের মধ্যে রয়েছে ২৪টি শিল্প। এর মধ্যে রয়েছে- প্লাস্টিক, জনশক্তি রফতানি, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, পরিবেশসম্মত জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, পর্যটন, হিমায়িত মৎস্য, হোম টেক্সটাইল সামগ্রী, নবায়নযোগ্য শক্তি, ভেষজ ওষুধ শিল্প, পলিমার উৎপাদন, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, অটোমোবাইল প্রস্তুত ও মেরামতকারী শিল্প, হস্ত ও কারু শিল্প, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি, চা, বীজ শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক শিল্প, জুয়েলারি, খেলনা, প্রসাধনী ও টয়লেট্রিজ, বাইসাইকেল ও আগর শিল্প।
৩৩টি সেবা শিল্পের মধ্যে রয়েছে নিউজ পেপার শিল্প, চলচ্চিত্র শিল্প, টেলিকমিউনিকেশন, ফটোগ্রাফি, বিনোদন শিল্প, নির্মাণ শিল্প ও হাউজিং, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, বিভিন্ন ধরনের টেস্টিং ল্যাবরেটরি, চেইন সুপার মার্কেট ও শপিং মল, অটোমোবাইল সার্ভিসিং ইত্যাদি। সংরক্ষিত ৪টি শিল্পের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পারমাণবিক শক্তি, অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি। নিয়ন্ত্রিত ২২টি শিল্পের মধ্যে রয়েছে স্যাটেলাইট চ্যানেল, এসিড উৎপাদনকারী শিল্প, কয়লা অনুসন্ধান, বেসরকারি খাতে ইন্সুরেন্স কোম্পানি, বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কার্গো বা জাতীয় পরিবহন বিমান, সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল, সমুদ্রবন্দর ও বা গভীর সমুদ্রবন্দর, ভিওআইপি টেলিফোন ও আইপি টেলিফোন, সৈকত বালি থেকে আহরণ করা ভারি খনিজ নির্ভর শিল্প ইত্যাদি।
২০১০ সালের পর ২০১৬ সালের নতুন শিল্পনীতি নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার রূপকল্প স্থির করেছে। নতুন শিল্পনীতিতে ১৬টি অধ্যায়ে কর্মকৌশল, শিল্পনীতির উদ্দেশ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা ও শ্রেণী বিন্যাস, বিনিয়োগ প্রণোদনা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প পার্ক, রাষ্ট্রয়াত্ত শিল্প ব্যবস্থাপনা ও সংস্কার, উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের গুণগত মান, মেধাসম্পদ সৃষ্টি ও সংরক্ষণ, শিল্পায়নে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ, রফতানিমুখী ও রফতানি শিল্প সংযোগ, পরিবেশবান্ধব শিল্প ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়ন, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ, গবেষণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নতুন শিল্পনীতিতে কর্মকৌশল নিয়ে ১২টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উৎপাদনভিত্তিক রফতানিমুখী ও আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপন। এর পাশাপাশি দেশজ সম্পদ সম্ভাবনা সঠিক ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ।
শিল্প ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিন্যাসে ২০টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ শিল্প, মাঝারি শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প, মাইক্রো শিল্প, কুটির শিল্প, হস্ত ও কারু শিল্প, হাইটেক শিল্প, সৃজনশীল শিল্প, সংরক্ষিত শিল্প, উচ্চ অগ্রাধিকার শিল্প, অগ্রাধিকার শিল্প ও নিয়ন্ত্রিত শিল্প। বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্প প্রতিষ্ঠানে জমি ও কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৫০ কোটি টাকার বেশি থাকতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩০০ জনের বেশি শ্রমিক রয়েছে সেগুলো বৃহৎ শিল্প হিসেবে গণ্য করা হবে। এছাড়াও তৈরি পোশাক, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি হতে হবে।
মাঝারি শিল্প বলতে শিল্প প্রতিষ্ঠানে জমি ও কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ১৫ কোটি টাকার বেশি থাকতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১২১ থেকে ৩০০ জনের বেশি শ্রমিক রয়েছে সেগুলো মাঝারি শিল্প হিসাবে গণ্য করা হবে। এছাড়াও তৈরি পোশাক, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি হতে হবে। কোনো একটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে একটি কর্মকাণ্ড মাঝারি শিল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেও, তা অন্য মানদণ্ডে বৃহৎ শিল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
ক্ষুদ্র শিল্প বলতে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে জমি ও কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৭৫ লাখ থেকে ১৫ কোটি টাকা থাকতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩১ থেকে ১২০ জনের বেশি শ্রমিক রয়েছে সেগুলো ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গণ্য করা হবে। এছাড়াও তৈরি পোশাক, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি হতে হবে। আর সেবা শিল্পের ক্ষেত্রে ১০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা থাকতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১৬ থেকে ৫০ জন শ্রমিক রয়েছে সেগুলো ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গণ্য করা হবে। মাইক্রো শিল্প বলতে ১০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকা থাকতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১৬ থেকে ৩০ জন শ্রমিক রয়েছে সেগুলো মাইক্রো শিল্প হিসেবে গণ্য করা হবে। কুটির শিল্প বলতে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা থাকতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ১৫ জন শ্রমিক রয়েছে সেগুলো কুটির শিল্প হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে হস্ত ও কারুশিল্প, হাইটেক শিল্প, সৃজনশীল শিল্প ও সংরক্ষিত শিল্পের বেলায় ব্যয় ও শ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখ করা নেই।
শিল্পনীতিতে বিনিয়োগ প্রণোদনার ক্ষেত্রে ১০টি বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ মূলধনী বিনিয়োগের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর্তুকি, উৎপাদিত পণ্যের ওপর থেকে কর ও শুল্ক অব্যাহতি, চলতি মূলধনের সুদের ওপর ভর্তুকি। এছাড়াও এলাকা ভেদে কর অবকাশ সুবিধা। অনাবাসিক বাংলাদেশির জন্য প্রণোদনা ব্যবস্থা রাখা হবে। পাশাপাশি অন্যান্য কর প্রণোদনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র, মাঝারি, মাইক্রো ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য ১৩টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জামানতবিহীন ঋণ ও সিঙ্গেল ডিজিট সুদের হার প্রবর্তন করা। অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প পার্ক, ক্লাস্টারভিত্তিক শিল্প, হাইটেক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১১টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে খাস জমি ও চর অঞ্চলের ভূমি নিয়ে একটি ‘ল্যান্ড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা। তবে পরিকল্পনাবিহীন যেখানে সেখানে শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা হবে। এছাড়া মেট্রোপলিটন শহরে স্থাপিত দূষণপ্রবণ শিল্পগুলো পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানান্তর করা হবে।
নতুন শিল্পনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের ক্ষেত্রে ৭টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতকে লাভজনক ও প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে ১০টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যের প্রবেশ সহজ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিল্পায়নে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ৭টি, রফতানিমুখী ও রফতানি সংযোগ শিল্পের জন্য মোট ১৩টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ রাখা হবে। পরিবেশবান্ধন শিল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ১০টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে শিল্পনীতি বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য কয়েকটি নীতি অনুসরণ করা হবে। এছাড়া দেশব্যাপী ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ‘জাতীয় শিল্প উন্নয়ন পরিষদ’ গঠন করা হবে। এর পাশাপাশি জাতীয় শিল্প পরিষদের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। যার আহ্বায়ক হবেন শিল্পমন্ত্রী।
Prev Post