৩৪ হাজার ইবতেদায়ি শিক্ষক ৩২ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার

0

Primaryমরার আগে যদি সরকার আমাদের দিকে একটু মুখ তুলে চাইত, আমাদের যদি জাতীয় স্কেলে বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করত; তাহলে সন্তানদের জন্য কিছু একটা করে যেতে পারতাম। আমাদের এ জীবনে তো আর সুখের মুখ দেখা হলো না। ছেলেমেয়েরা জানে আমরা চাকরি করি। কিন্তু মাস শেষে আমরা কোনো বেতন পাই না। ঈদের সময় সব চাকরিজীবী তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনেন। কিন্তু আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে পারি না। এ দুঃখ কোথায় রাখি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ৩২ বছর ধরে শিক্ষকতায় রত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক মো: ইন্তাজ বিন হাকিম। তিনি নাটোর বড়াইগ্রাম আটাই ইবতেদায়ি মদারসায় ১৯৮৪ সাল থেকে শিক্ষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজারেরও বেশি প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ করেছেন এক ঘোষণায়। আর আমাদের সামান্য কয়েকটি স্কুল সরকার জাতীয়করণ করতে পারল না? প্রধানমন্ত্রী রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল যখন জাতীয়করণের ঘোষণা করলেন, তখন আমরাও বড় আশায় ছিলাম এবার হয়তো আমাদের মাদরাসাও সরকারি হবে। কারণ ১৯৯৪ সালে সরকার একই পরিপত্রে দেশের সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল এবং প্রতি ইউনিয়নে একটি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা নির্ধারণ করে। পরে প্রায় সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল সরকারি করা হলেও আমাদের দিকে কোনো নজর দিলো না কেউ।
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার আড়ালিয়া পাটওয়ারীকান্দি ইয়াসমিন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক জাতীয় প্রেস কাবের সামনে ব্যথিত কণ্ঠে বলেন, আমার সাত ছেলেমেয়ে। আমি বর্তমানে নানা হয়েছি। আমিও ১৯৮৪ সাল থেকে শিক্ষকতা করে আসছি। সরকারি কোনো বেতনভাতা ছাড়াই আমি চাকরি জীবন শেষ করতে যাচ্ছি। এক দিন সরকার আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবে এই আশায় ৩২টা বছর পর করে দিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। অভাবে ছেলেমেয়েদের ভালো পড়ালেখা করাতে পারিনি। আমরা মারা যাচ্ছি। আমাদেও জন্য কিছু একটা করেন।
জাতীয় প্রেস কাবের সামনে দাঁড়িয়ে একই উপজেলার বালিয়াকান্দি আহমেদিয়া ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক আব্দুল মতিন বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছি। আমরা কোনো সরকারি ভাতা পাই না। আমার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। অর্থের অভাবে তাদের পড়ালেখা করাতে পারি না। বিনা বেতনে যুগের পর যুগ শিক্ষকতা করে যাচ্ছি এক দিন হয়তো সরকার আমাদের দিকে তাকাবে এই আশায়। আমাদের মতো অনেক শিক্ষক আশায় আশায় থেকে অবসরে চলে গেছেন কোনো কিছু না পেয়ে। অনেক মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে।
নেত্রকোনার পূর্বধলা রেলওয়ে ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক মো: শাহজাহান কবির বলেন, আমি ১৯৭৯ সাল থেকে এ মাদরাসায় শিক্ষকতা করে আসছি। প্রথমে এটি ফোরকানিয়া মাদরাসা ছিল। পরে ১৯৮৪ সালে ইবতেদায়ি করা হয়। শাহজাহান কবির বলেন, আমরা খেয়ে-না-খেয়ে কোনোমতে টিকে আছি। সন্তানদের লেখাপড়া করাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছি।
গত বুধবার থেকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা জাতীয় স্কেলে বেতন ঘোষণার দাবিতে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি, সমাবেশ করছেন। ওপরের কয়েকজনসহ অনেক শিক্ষককের সাথে কথা বলার সময় তারা তুলে ধরেন তাদের মানবেতর জীবনযাপনের কথা। তারা জানান, কেউ ইমামতি করেন, কেউ কাজী, কেউ অন্যান্য টুকটাক কাজ করে কোনোমতে তারা সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজী রুহুল আমিন চৌধুরী, সহসভাপতি মো: তাজুল ইসলাম ফরাজী, মহাসচিব কাজী মো: মোখলেছুর রহমান স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ১৯৮৪ সালে ১৯ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার রেজিস্ট্রেশন দেয়। এরপর ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে সরকার দেশের সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল এবং প্রতি ইউনিয়নে একটি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা নির্ধারণ করে।
তারা আরো বলেন, সরকার ধাপে ধাপে প্রায় সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধি করে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি স্কুল সরকারীকরণ করেছে। এর মধ্যে অল্প কিছু স্কুল বাদে বাকি প্রায় সব স্কুলই রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল। এ সরকার প্রায় সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলকে জাতীয়করণ করলেও বিপরীত দিকে অবহেলার কারণে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা বন্ধ হতে হতে বর্তমানে মাত্র ছয় হাজার ৯৪৯টিতে এসে ঠেকেছে। সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় বোর্ড স্বীকৃত ১২ হাজার ১৫২টি মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শিক্ষক কয়েক যুগ ধরে অপেক্ষা করতে করতে শেষে একরাশ হতাশা নিয়ে অবসরে চলে গেছেন।
শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জানান, ১৯৯৪ সালে সরকার প্রতি ইউনিয়নে একটি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে তা থেকে সরে আসে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে। পরে জারি করা নীতিমালায় বলা হয় প্রাইমারি স্কুলের কাছাকাছি যেসব মাদরাসা রয়েছে, তাদের ভাতা দেয়া হবে না। ফলে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার শিক্ষকদের মাসে মাত্র ৫০০ টাকা ভাতার আওতায় আনা হয়। ২০১৩ সালে এ ভাতা এক হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়।
২০১১ সালের মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে চালু থাকা ছয় হাজার ৮৪৮টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ৩৪ হাজার ২৪০ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। শিক্ষকেরা জানান, সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মতো আমরাও সব সরকারি নিয়ম মেনে শিশুদের শিক্ষা দিয়ে থাকি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও সরকার বিনা মূল্যে বই দেয়, উপবৃত্তি দেয়, বিস্কুট খাওয়ায়। আমাদের এখান থেকে পাস করে পরে তারা দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসায় ভর্তি হয়। ফিডার স্কুল হিসেবে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা বিরাট অবদান রেখে আসছে।
কিন্তু সীমিত কয়েকটি মাদরাসা ছাড়া আমরা কোনো সরকারি বেতনভাতা পাই না। যারা মাসে এক হাজার টাকা পান তাও বর্তমান জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। এত বঞ্চনা ও বৈষম্য সত্ত্বেও এসব শিক্ষকেরা আশায় বুক বেঁধে আছেন এক দিন হয়তো সরকার আমাদের দিকে নজর দেবে।
শিক্ষক নেতৃবৃন্দ নয়া দিগন্তকে জানান, ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর আমরা সমাবেশ করি জাতীয় প্রেস কাবের সামনে। সেখানে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রধান অতিথি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বিশেষ অতিথি ছিলেন। অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রাইমারি সমমানের সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের জাতীয় স্কেলে বেতনসহ সব সুযোগ সুবিধা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক। শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে মর্মে তিনি আশ্বাস দেন। গত বছর ১০ জুন শিক্ষক সমাবেশে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া সংসদ সদস্যদের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
গত বছর ৮ নভেম্বর সংসদ চলাকালে সব সংসদ সদস্য বরাবর চিঠি দিয়ে জাতীয় বেতন স্কেল বিষয়ে অবহিত করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি সব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয় জাতীয় বেতন স্কেলের দাবিতে। এ ছাড়া দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।
নেতৃবৃন্দ বলেন, কিন্তু আজ অবধি কেউ আমাদের দিকে কোনো নজর দিলেন না। তাই দুই মাস আগে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মসূচির ঘোষণা করি। ঘোষণা অনুযায়ী গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে কর্মসূচি পালন করে আসছি।
সংগঠনের সহসভাপতি মো: তাজুল ইসলাম সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমরা দীর্ঘ দিন অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে পার করেছি। সবাই আশা নিয়ে এতটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। আমরা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমাদের দু’মুঠো ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করেন। আমাদের সন্তানদের শিক্ষাসহ মানসম্মত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করেন। আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। – See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/93374#sthash.VpoBstAZ.dpuf

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More