প্রতিদিন রাজধানীতে ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য

0

Untitled-1 copyঢাকা : ডান হাতের কব্জিটি একটু বাঁকা রফিকুল ইসলামের। প্রথম দেখায় প্রতিবন্ধী ভেবে তার প্রতি সহানূভুতি প্রকাশ করেন সবাই। আর এ সহানুভূতি আকর্ষণই তার অস্ত্র! কাওরানবাজারের সিগন্যালে সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী রেশমা আক্তার দয়াপরবশ হয়ে পাঁচ টাকার একটি কচকচে নোট বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! নোট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রফিকুল বলেন, ‘ওই বুড়িরে ২০ ট্যাকা দিলেন। আর আমি ল্যাড়া, আমারে দেন পাঁট ট্যাকা?’ যানজটে হাত বাড়িয়ে দেয়া ভিক্ষুকদের মধ্যে বেছে বিবেচনা করে টাকা দান করছিলেন গৃহিনী রেশমা। বিজয় সরণির সিগন্যাল থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত শতাধিক ভিক্ষুকের মধ্যে যাদের দেখে সহানুভূতি জাগছিল প্রতিবন্ধী কামাল ইসলাম তাদেরই একজন। তবে এই সহানুভূতির মূল্য যে এভাবে পাবেন তা কল্পনা করেননি। ‍কামালের আচরণে বিব্রত রেশমা ২০ টাকা দিতে বাধ্য হলেন। বনানী থেকে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের উদ্দেশে যাওয়া এ গৃহিনী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দান-খয়রাত করা সওয়াবের কাজ। তবে ঢাকায় কাকে দান করব তা নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ি। শুনি অনেকেই ব্যবসা করছে। কে যে গরিব আর কে যে প্রতারক বোঝা যায় না। এখন টাকা কম দিলেও নিতে চায় না। বোঝেন, ভিক্ষুকও ডিজিটাল হয়ে গেছে…!’

কামাল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকায় টাকার আশায় তিনি এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে। আজিমপুরে ভিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু জায়গা পাননি তিনি। এরপরও আশা করছেন বাড়িতে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ফিরতে পারবেন।

শুধু কামাল ইসলামই নয়, প্রায় ৫০ হাজার মৌসুমী ভিক্ষুক ভারি করে তুলেছে রাজধানীর রাজপথ। ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় জড়ো হওয়া এসব মানুষের কারণে বিব্রত গৃহিনী লাবনীর মতোই লাখ লাখ নগরবাসী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীতে অন্তত ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হচ্ছে। পুরো মাসে এই ভিক্ষার টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা। ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের সংঘবদ্ধ চক্রগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে চালায় ভিক্ষা বাণিজ্য। আর এ কারণেই উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভিক্ষায় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের।

এদিকে রাজধানীর ভিআইপি এলাকাসহ সাতটি এলাকায় গত বছর ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আবারও এসব এলাকায় ভিক্ষা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায়- বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, হাইকোর্ট মাজার ও মসজিদ, মিরপুর শাহ আলী মাজার ও মসজিদ, গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার, গুলশান-১ ও ২ গোলচত্বর, কাকরাইল মসজিদ, মহাখালী রেলগেট মসজিদ, চকবাজার মসজিদ, আজিমপুর কবরস্থান, মতিঝিল, গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ, উত্তরা ও বনানীর মসজিদগুলোর কাছে।
টাকা ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছে অভিনব ভিক্ষুক সিন্ডিকেট, আয় ৬শ কোটি টাকা রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা- এসব অভিজাতপাড়ায় যাকাত-ফিতরার টাকা তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। এজন্য টাকা আদায়ে ছিন্নমূলদের প্রধান টার্গেট থাকে এসব এলাকা। এখন শহরের বিপণিবিতানের সামনে এবং ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহন আটকে গেলে ঘিরে ধরে ভিক্ষুকের অসংখ্য হাত। প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে বেড়েছে ভিক্ষুকের আনাগোনা।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় ৫০ হাজার নিয়মিত ভিক্ষুক আছে। তবে ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে বর্তমানে এ সংখ্যা অন্তত দেড় লাখ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, মাদারিপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা হয়েছে বেশিরভাগ মৌসুমী ভিক্ষুক। তাদের থাকার জন্য রাজধানীর মিরপুর দিয়াবাড়ি বেড়িবাঁধ, বাউনিয়া বাঁধ, গাজারিবাগ বেড়িবাঁধ, কামরাঙ্গীর চর, মোহম্মদপুর বেড়িবাঁধ, শনির আখড়া, আব্দুলাহপুর ও টঙ্গীর বিভিন্ন খুপরি ঘর ভাড়া নেয়া হয়েছে। সিন্ডিকেটকে নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে এরা রাজধানীতে ভিক্ষা করছে।

শাহবাগ এলাকার ভিক্ষুক মোবারক হোসেন ও ফাহিমা খাতুন দাবি করেন, একজন ভিক্ষুকের প্রতিদিন গড় আয় দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। আরও কয়েকজন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন রাজধানীতে অন্তত ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হয়। পুরো মাসে যার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা।

ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে বাসস্ট্যান্ডে বাবুল নামে এক মৌসুমী ভিক্ষুক জানান, তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। এবারই প্রথম ঢাকায় এসেছেন। তাকে ঢাকায় একটি রিকশা গ্যারেজে নাইটগার্ডের কাজের কথা বলে আনা হয়। কাজে নামানোর আগে ভিক্ষার কথা জানানো হয়েছে। প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু কিছু করার ছিল না। এখন প্রতিদিনের ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় লাইনম্যানকে।
ভিক্ষুকরা জানান, ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করেও চলে চাঁদাবাজি। অন্তত ৩০০ পয়েন্টে একজন করে লাইনম্যান ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আছে আলাদা সিন্ডিকেট।

স্থানীয় কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিক্ষুকদের একটি সিন্ডিকেট। টুণ্ডা আমান উল্লাহ ও কানা ফজলুর নেতৃত্বে ২০ জন এসব দলের প্রধান। বাড়তি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে তারা নানা প্রলোভনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী- পুরুষ ও শিশুদের অগ্রীম টাকা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় এ চক্রের তহবিলে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More