গুজরাটে মুসলমানদের কথা বলা মানেই কি ভোটে পরাজয়?

0

দুই দশক আগে দাঙ্গার বছরেই বিধানসভার ভোটে বিপুলভাবে জিতে প্রথমবার পুরো পাঁচ বছরের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি ভুলে যেতে চায় সেই ইতিহাস? কেন তারা দাঙ্গার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়?

দাঙ্গার পরের নির্বাচনে মুসলমান-প্রধান এলাকায় প্রচারেও যায়নি কংগ্রেস প্রার্থীরা।

যেসব এলাকায় দাঙ্গা বেশি হয়েছিল, সেখানেই বেশি আসন পেয়েছিল বিজেপি।

চাকরির বিজ্ঞাপনে উচ্চবর্ণের অগ্রাধিকার

২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল সাফাইকর্মী নিয়োগের একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল।

আহমেদাবাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিউমান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের দেয়া ওই বিজ্ঞাপনটায় কয়েকটা শর্ত ছিল : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বানিয়া, প্যাটেল আর জৈন সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। বিজ্ঞাপনের শেষে সই করেছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির পরিচালক প্রসাদ চাকো।

সাফাইকর্মী নিয়োগের ওই বিজ্ঞাপনটা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল, কারণ তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের সেখানে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা লেখা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপনটা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির দফতরে হামলাও হয়েছিল।

যারা সেই হামলা চালিয়েছিল, তার মধ্যে বেশকিছু দক্ষিণপন্থী সংগঠন যেমন ছিল, তেমনই সেদিন হাজির হয়েছিলেন কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন এনএসইউআইয়ের কর্মী-সমর্থকরাও।

পরিচালক প্রসাদ চাকোকে আত্মগোপন করতে হয়েছিল ওই বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য।

চাকোর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি ওই বিজ্ঞাপনটা কেন ছেপেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে পুরো বিষয়টা খুব পরিষ্কার ছিল। উচ্চবর্ণের মানুষরা তো সংরক্ষণের বিরোধিতা করে থাকেন। তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম, যে কাজটা প্রাচীনকাল থেকে দলিত শ্রেণীর মানুষরাই করে আসছেন, সে রকম একটা কাজের জন্য উচ্চবর্ণের লোকেদের নিয়োগ করার প্রশ্নে কী রকম প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়াটা তো দেখাই গেল।’

‘কংগ্রেসে সাম্প্রদায়িক মানুষ মিশে আছে’

‘পি সি চাকোর ওই পরীক্ষাটা খুবই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। উচ্চবর্ণের মানুষদের চিন্তাভাবনা একেবারে প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল,’ বলছিলেন আহমেদাবাদের সিনিয়র সাংবাদিক রাজীব শাহ।

‘চাকোর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে এনএসইউআই’র ছাত্রদের হামলা চালানোর মাধ্যমে বোঝা গিয়েছিল যে গুজরাটের কংগ্রেস দলের মধ্যে কিভাবে জাতীয়তাবাদী আর সাম্প্রদায়িক ভাবনার উচ্চবর্ণের মানুষ মিশে আছে। ২০০২ সালের দাঙ্গার পর থেকেই গুজরাটের ভোটে কংগ্রেস যে কিভাবে ভয়ে ভয়ে বিজেপির মোকাবেলা করে, সেটা তো দেখাই গেছে। হিন্দুত্ব ও সংখ্যাগুরুত্বের যে রাজনীতি বিজেপি করে তার সরাসরি বিরোধিতা করতে কংগ্রেস আসলে ভয় পায়,’ বলেন রাজীব শাহ।

তিনি বলেন, কংগ্রেস মনে করে যে তারা যদি ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আনে, তাহলে ভোটের সময়ে দলের ক্ষতিই হবে।

দাঙ্গার বছরের কথা তুললে কি হিন্দুরা ভয় পায়?

এটা কতটা সত্যি যে ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ যদি কংগ্রেস তোলে তাহলে গুজরাটের হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে বিজেপির পক্ষে এককাট্টা হয়ে যাবে?

রাজীব শাহের বক্তব্য, ‘কংগ্রেসের এই ভয়টা পাওয়া যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আমার নিজেরও মনে হয় যে গুজরাটের শহুরে মধ্যবিত্ত হিন্দুরা ২০০২ সালের দাঙ্গা নিয়ে প্রত্যয়ী। এই অবস্থায় কংগ্রেস যদি দাঙ্গার বিরোধিতা করতে যায়, তাহলে মধ্যবিত্তরা আরো বেশি করে বিজেপির দিকে চলে যেতে পারে। কিন্তু এটাও সত্যি যে কংগ্রেস এই নীতি নিয়ে চললে বিজেপিকে হারাতে পারবে না কখনোই। বিজেপিকে হারাতে হলে তার সাথে সরাসরি টক্কর দিতে হবে।’

২০০২ সালেই ডিসেম্বরে গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল।

যেসব এলাকায় দাঙ্গা সবথেকে বেশি হয়েছিল, সে রকম ৬৫টি আসনের মধ্যে ৫৩টিতেই জিতেছিল বিজেপি।

‘বিজেপি ভেদাভেদের রাজনীতি করে না’

গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির সিনিয়র নেতা নীতিন প্যাটেল বলেন, ‘২০০২ সালের গুজরাটে যে দাঙ্গার কথা যারা বলেন, তারা এটা ভুলে যান যে গোধরায় কী হয়েছিল। কংগ্রেস রাজত্বেই সব থেকে বেশি দাঙ্গা হয়েছে আর বিজেপি আসার পরে তো পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা তুষ্টিকরণের রাজনীতি করি না।’

এ প্রসঙ্গে বিজেপির অবস্থান যে এ রকমই হবে, তা আন্দাজ করা কঠিন ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস কেন এ রকম অবস্থান নিয়েছে গুজরাটে?

আহমেদাবাদের সেন্টার ফর সোশ্যাল নলেজ অ্যান্ড অ্যাকশানের পরিচালক ও সমাজবিজ্ঞানী অচ্যুত ইয়াগনিক বলেন, ‘কংগ্রেস শিবির মনে করে যে ওই প্রসঙ্গে যদি কিছু না বলা যায়, তাহলেই তাদের বেশি সংখ্যক ভোট দিয়ে যাবে মানুষ। তাই এরকম একটা নীতি নিয়েছে তারা যে দাঙ্গা নিয়ে কিছু বলবেই না তারা।’

২০০২ সালের বিধানসভা ভোটে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়ার পরে সোনিয়া গান্ধীর কাছে একটা রিপোর্ট দিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা।

অচ্যুত ইয়াগনিক বলেন, ‘ওই রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, যেসব আসনে ২৫ হাজারের বেশি মুসলমান ভোটার আছেন, সেসব আসনেই কংগ্রেস হেরেছে। কংগ্রেস প্রার্থীরা মুসলমান এলাকায় প্রচার পর্যন্ত করতে যাননি। পার্টি একটা অনুচ্চ হিন্দুত্বের লাইন নিয়েছিল, তবে সেটা কিন্তু রাজ্যে কংগ্রেসকে শক্তি যোগাতে পারেনি। গুজরাটে হিন্দুত্বের জবাব হিন্দুবিরোধী রাজনীতি দিয়েই করতে হবে। তাদের সেই প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি।’

কংগ্রেস ভুলতে চায় দাঙ্গার কথা?

রাজস্থানের সাবেক মন্ত্রী রঘু শর্মাকে কংগ্রেস এবারের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা অতীতের দিকে তাকাতে চাই না। ২০০২ সালের দাঙ্গা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। এবারে উন্নয়ন নিয়ে কথা হোক। প্রশ্ন উঠুক এখানকার বেকারত্ব, গরিবি আর শিক্ষা নিয়ে।’

রাহুল গান্ধী যেখানে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে সরাসরি আক্রমণের পথে হাঁটেন, সেখানে গুজরাটে কংগ্রেস তা থেকে বিরত থাকে?

এই প্রশ্নে রঘু শর্মা বেশ রেগে গেলেন।

বললেন, ‘রাহুল গান্ধী হিন্দুত্ব বা হিন্দুদের বিরোধী নন। আপনারা বরং নিজেদের এজেন্ডা থেকে বেরিয়ে আসুন। আমরা হিন্দু ধর্মের বিরোধী নই। আপনি আমাকে এ ধরনের প্রশ্ন করে বিপদে ফেলতে চাইছেন।’

সমাজবিজ্ঞানী অচ্যুত ইয়াগনিক বলেন, ‘কংগ্রেস নেতাদের তো আগে তাত্ত্বিক জ্ঞান বৃদ্ধি দরকার। কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতা তো এটাই বোঝেন না যে হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম এক ব্যাপার নয়।’

ভোটে বিজেপি মুসলমানদের প্রার্থী করে না, যদিও রাজ্যে ১০ শতাংশ বাসিন্দা মুসলমান। আর এর মোকাবেলায় কংগ্রেসও মুসলমানদের প্রার্থী করা কমিয়ে দিয়েছে।

কংগ্রেস কত টিকিট দেবে মুসলমানদের?

গত বিধানসভা ভোটে তারা মাত্র ছয়জন মুসলমানকে প্রার্থী করেছিল, যার মধ্যে তিনজন জয়ী হয়েছিলেন।

দরিয়াপুর আসনের কংগ্রেস বিধায়ক গিয়াসুদ্দিন শেখ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানদের অন্তত ১৮টি টিকিট পাওয়া উচিত, কিন্তু যদি এতটা না দিতে পারে দল, তাহলে অন্তত ১০-১১টা টিকিট দেয়া হোক।

এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা রঘু শর্মা বলেন, ‘দল তাদেরকেই টিকিট দেয়, যাদের জেতার সম্ভাবনা আছে।’

শুধু মুসলমানদের টিকিট না দেয়া বা ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ উত্থাপন না করাতেই যে কংগ্রেসের নীতি সীমাবদ্ধ থাকছে, তা নয়।

সম্প্রতি নবরাত্রিতে গরবা নাচের অনুষ্ঠানে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগে কয়েকজন মুসলমান যুবককে যেভাবে রাস্তায় বেঁধে পেটানো হয়েছে, তা নিয়েও কংগ্রেস কোনো কথা বলেনি।

তবে গিয়াসুদ্দিন শেখ ও আরেক কংগ্রেস বিধায়ক ইমরান খেড়াওয়ালা ওই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।

খেড়াওয়ালা মন্তব্য করেছিলেন যে, ওই ঘটনায় দল চুপ থাকায় সংখ্যালঘুদের কপালে কংগ্রেসকে নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

মুসলমানদের নিয়ে কথা বলা কি পাপ?

ভাদোদরার সামাজিক কর্মকর্তা জুবেইর গোপলানী মনে করেন, গুজরাটে মুসলমানদের নিয়ে আলোচনা করাটা যেন একটা পাপ কাজ।

‘বিজেপির কাছ থেকে তো কিছু আশাই করা যায় না। ভোটে জেতার জন্য মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাটাই বিজেপির দরকার। কিন্তু আমরা কংগ্রেসের কাছে আশা করতাম যে তারা ওই ঘৃণার চূড়ান্ত বিরোধিতা করবে। তবে তারা হয়তো মনে করে যে সেরকম কোনো পদক্ষেপ নিলে তারা ভোটে হারবে। কংগ্রেস ২০০২ এর দাঙ্গার কথা কি ভুলিয়ে দিতে চায়, নাকি জেনে বুঝেই তারা স্মরণ করতে চায় না সেই সময়টা!’

‘রাহুল গান্ধী আশা দেখান। হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণে যান তিনি, কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস পুরোপুরি বিপরীত অবস্থান নিয়ে চলে। রাহুল গান্ধীকে তো আমার মনে হয় সোনিয়া বা রাজীব গান্ধীর থেকেও অনেক বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। সে জন্যই হয়তো সংবাদমাধ্যমের একাংশে তাকে ‘পাপ্পু’ বলে মশকরা করা হয়।’

২০০২ সালের দাঙ্গা নিয়ে শুধু যে কংগ্রেস নিশ্চুপ থাকে তা নয়।

ওই রাজ্যে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চাইছে যে আম আদমি পার্টি, তারাও কিন্তু বিলকিস বানোর গণধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া নিয়ে কোনো কথা বলেনি।

উৎসঃ   বিবিসি বাংলা
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More