বাসর রাত ও বিড়ালকাহিনি

0

basorছোট ফুফু বেশ ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কি সত্যিই কোনো প্ল্যানপ্লুন নেই?’
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেয়ালে শিকারের অপেক্ষায় থাকা একটা টিকটিকি দেখছিলাম। ফুফুর গলার ঝাঁজে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে, তা দেখার সৌভাগ্য হলো না। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কয়েকটা টিকটিকি মারলে কেমন হয়?’
এবার রীতিমতো হুংকার ছাড়লেন তিনি, ‘থাপড়ায়ে দাঁত ফেলে দিব! আমি তোর সাথে ইয়ার্কি করছি?’
দাঁত ফেলে দেওয়ার কথায় দমে গেলাম। ফুফুর ধারণা, আমার মতো একটা ‘হ্যাবলাকে’ বউ নামক মানুষটি উঠতে-বসতে ‘বেচে খাবে’! কাজেই তেমন কিছু যাতে না হয়, তার জন্য এখনই ‘প্ল্যানপ্লুন’ করা দরকার! আমার এই ফুফু আমার দেখা দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা এবং ভয়ংকরতম নারী। আমাদের গোষ্ঠীতে অন্ত কিংবা আন্তপারিবারিক ঝুট-ঝামেলায় পরামর্শক হিসেবে তো কাজ করেনই, ধমকি-ধামকি এবং চড়-থাপড় দেওয়ার কাজগুলোও নিজে দায়িত্ব নিয়ে করেন!
খানিক বাদেই একটু সুর নরম করে বললেন, ‘বাসর রাতে বিড়াল মারার কথা যে বলেছি, গল্পটা জানিস তো? বউকে যা টাইট দেওয়ার, বাসর রাতেই দিতে হয়!’
আমি একটু হাই তোলার মতো ভঙ্গি করে বললাম, ‘এই মেয়ে তো আধুনিক যুগের। বিড়াল-টিড়াল মারলে ভয় পাবে না। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে বরং খাঁচায় বন্দী বাঘ-সিংহের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়!’
এবার আর মুখে নয়, চোখের অগ্নিদৃষ্টি দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন যে ‘থাপড়ায়ে’ আরও একবার দাঁত ফেলতে ইচ্ছুক তিনি! আমি আবারও দমে গিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, তুমিই বলে দাও কী করতে হবে।’
‘আজ বাদে কাল বিয়ে। এখন তো আর তেমন কিছু ভেবে বের করা যাবে না। তুই বরং তোদের পোষা বিড়ালটাকেই…’
ফুফু কথা শেষ করতে পারলেন না। এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা ফুফা বলে উঠলেন, ‘তোমার মাথাটাথা খারাপ হয়েছে নাকি! কী আবোলতাবোল বকছ!’
ফুফু নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, খারাপ হয়েছে তো মাথা! এখন তুমি কী করবে?’
ফুফা এমনভাবে চুপ করে গেলেন যে আমি বুঝলাম, ছোট ফুফুর মতো কারও মাথা খারাপ হলে কী করা উচিত, সেটা তাঁর জানা নেই! ফুফু আমার দিকে তাকিয়ে কী একটা বলতে গিয়ে আবার ফুফার দিকে চেয়ে বললেন, ‘যেভাবে বসে আছে, ওভাবেই চুপ করে বসে থাকুক। কথার মধ্যে বাঁ হাত ঢোকানোর দরকার নেই!’
তারপর আমাকে হাতেকলমে শিখিয়ে-পড়িয়ে দিলেন, কীভাবে কী করতে হবে। আগে থেকেই বাসার আধপোষা কম বয়সী বিড়ালটাকে খাটের নিচে রেখে আসা হবে। বিড়াল তো আর ছোট ফুফা নয় যে চুপচাপ বসে থাকবে! তার কাজই হচ্ছে মিউ মিউ করা! আর যে-ই মিউ করবে, আমার কাজ হবে মুখে চূড়ান্ত বিরক্তির ভাব এনে ‘এইটা আবার কোত্থেকে আসল’ বলে খেল দেখানো!
আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম! কিন্তু ফুফুর কথা না শুনে উপায় নেই। এই বোকা মানুষটার কথায় অন্যথা হলে বিয়েবাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। তা ছাড়া ব্যাপারটা দেখে নতুন বউ কেমন ভড়কে যায়, সেটাও খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।
অবশেষে ‘আজ বাদে কালের’ সেই বাসর রাত এল। পরিকল্পনামাফিক সবকিছুই হয়েছে। এখন ধর তক্তা মার পেরেক! কিন্তু বাসরঘরে ঢুকেই আক্কেলে বিরাট ধাক্কা লাগল। খাটের ওদিক থেকে আওয়াজ এল, ‘ফ্যানের সুইচটা অন করেন তো, গরমে দম বন্ধ হয়ে আসছে!’ তাকিয়ে দেখি ঘোমটা-টোমটা ফেলে উনি আয়েশ করে বসে আছেন! এটা কেমন কথা! এত দিন কল্পনা করে আসছি, সিনেমাটিক কায়দায় গিয়ে ঘোমটা সরিয়ে থুতনি একটু ওপরে তুলে বলব, ‘বাহ্, কী অপূর্ব!’ আর এখন?
পাশে গিয়ে বসতেই রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিল। কত কী কাহিনি! কিন্তু বিড়ালটার হয়েছেটা কী? কতক্ষণ হয়ে গেল অথচ মিউ করার নাম নেই! খানিক পর আমার অস্থিরতা দেখে চোখে কৌতুক নিয়ে বলল, ‘বিড়াল খুঁজছেন?’ আমার হাঁ করা মুখের দিকে না চেয়েই বলতে লাগল, ‘সেই তখন থেকে মিউ মিউ করছে, তাই একটা আছাড় দিয়ে দিলাম শেষ করে!’
তারপরই প্রাণখোলা হাসিতে ঘর কাঁপিয়ে, আঁচলের নিচ থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা বিড়ালটা বের করে আহ্লাদি গলায় বলল, ‘এমন বোকাও মানুষ হয়! এই গল্প তো সবারই জানা। আর ভালোবাসা ছাড়া আমাকে অন্য কোনো জিনিস দিয়ে কাবু করা যাবে না, সেটা আগেই বলে দিচ্ছি!’ ততক্ষণে আবিষ্কার করলাম অন্ধকার ঘরে তার একটা হাত আমার হাতে!

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More