বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের একমাত্র সংবাদপত্র দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধের পরও পত্রিকাটি আবারো চালু করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন মালিকপক্ষ। তারা বলছেন যে, এরইমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরিবর্তে অন্য আরেকজনকে পত্রিকাটির প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার আবেদন করা হয়েছে।
দৈনিক দিনকাল পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, “এই পত্রিকাটা চালু রাখার জন্য আমরা সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাবো।”
গত ২৬শে নভেম্বর, ‘প্রকাশক কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করায়’ পত্রিকাটির প্রকাশনা বাতিলের আদেশ জারি করে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পরে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ গত ২৯শে ডিসেম্বর এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। একই সাথে তারা প্রকাশনাও চালিয়ে যায়।
গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধের বিরুদ্ধে করা আপিলটি বাতিল করে দেয়। সেদিনই অনলাইনে পত্রিকাটির সবশেষ সংস্করণ বের হয়। এর পর থেকে আর সেখানে নতুন কোন খবর প্রকাশিত হয়নি।
দিনকাল কি আবার আসবে?
দৈনিক দিনকাল আবারো প্রকাশ করা হবে কিনা তা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি পত্রিকাটির সাথে সংশ্লিষ্টরা।
পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানান, এরই মধ্যে নতুন প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব নিতে আবেদন করেছেন বিএনপি নেতা আহমেদ আজম খান।
গত ১৫ই জানুয়ারি এ বিষয়ে যথাযথ ফর্ম পূরণ করে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং প্রেস কাউন্সিলে জমা দেয়া হয়েছে। একই সাথে তারেক রহমান যে পত্রিকাটির প্রকাশকের পদ ছাড়ছেন সেটির আবেদনও যথাযথ ফর্ম পূরণ করেই জমা দেয়া হয়েছে।
তবে তারপরও তাদের আপিল বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “ডিসি সাহেবরা একটা নির্দেশনা দিয়ে দিনকাল চালু রাখতে পারতো, কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি।”
দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. রেজওয়ান সিদ্দিকী বলেন, দিনকাল আবারো চালু হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত একেবারেই সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে।
তিনি জানান, দিনকাল আবার আসতে হলে কিছু জটিল আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার তিন মাস পর সেটি আবার চালু করতে নতুন একজন প্রকাশক আবেদন করবেন।
পত্রিকাটির নতুন প্রকাশক হতে ইচ্ছুক আহমেদ আজম খান বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং তিনি দলটির বিভিন্ন সভাসমাবেশে সরকারি বিরোধী বক্তব্যও দিয়েছেন। এজন্য মি. সিদ্দিকী মনে করেন যে, এ কারণে তাকে পত্রিকাটি প্রকাশের অনুমতি নাও দেয়া হতে পারে।
ফলে এই পত্রিকাটি আবার আসবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে বলে মনে হচ্ছে।
যে কারণে বন্ধ
আইন অনুযায়ী, কোন পত্রিকার প্রকাশক যদি একটানা ছয় মাসের বেশি দেশের বাইরে থাকেন তাহলে তাকে তার দায়িত্ব অন্য কাউকে হস্তান্তর করতে হয়। বলা হচ্ছে, দিনকালের ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যতিক্রম হয়েছে কারণ প্রকাশক তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে দেশের বাইরে।
তবে তিনি বাধ্য হয়েই দেশের বাইরে রয়েছেন উল্লেখ করে মি. বিশ্বাস বলেন, “আমাদের প্রকাশক দেশের বাইরে আছেন কী কারণে সেটা দেশবাসী সবাই জানে।”
২০১৬ সালে যখন একটি মামলায় যখন তারেক রহমানকে দণ্ড দেয়া হয় তখন তিনি একটি এফিডেভিট করে প্রকাশকের দায়িত্ব দেন আহমেদ আজম খানকে। এই নথি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানোর জন্য জমা দেয়া হয়েছিল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাই কমিশনে। যা এখনো জেলা প্রশাসন পায়নি বলে জানা যায়।
মি. বিশ্বাস বলেন, “ওনারা এই চিঠিটা আজকে ছয় বছরের মধ্যে পাঠায়নি, এটা কোন গুরুত্ব দেয়নি।”
পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বলেন, “কোন কিছু হাই কমিশন অথেনটিকেট করে না পাঠালে সেটা লিগ্যালি গ্রহণ করছে না ডিসি অফিস।”
যার কারণে এই জটিলতায় পড়ে শেষমেশ পত্রিকাটি বন্ধ করারই নির্দেশ এসেছে।
এছাড়া ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের প্রকাশনা শাখা থেকে ২৬শে ডিসেম্বর যে চিঠি দিনকাল অফিসে পাঠানো হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, “পত্রিকাটির প্রকাশক কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করায়, ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অফিসের ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করায় তারেক রহমানের নামে পত্রিকা মুদ্রণের যে ঘোষণাপত্র দেয়া হয়েছিলো তা বাতিল করা হলো”।
মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা?
দৈনিক দিনকাল পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধের ঘোষণা আসার পর গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধীদল বিএনপি একটি বিবৃতি দেয়। যেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সরকারের নির্দেশে জেলা প্রশাসক পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করেছেন এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলও পত্রিকাটির আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত।”
দৈনিক দিনকালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মি. বিশ্বাস বলেন, তারা মনে করেন তাদের কথা বলা এবং লেখার অধিকারের উপরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অংশ হিসেবে এই পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যার কারণে এই পত্রিকাটি আবার চালু করার দাবি জানাচ্ছেন তারা।
“বন্ধের (সংবাদ মাধ্যম) এই যে সংস্কৃতি এটা বন্ধ করা উচিত,” বলেন তিনি।
পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. রেজওয়ান সিদ্দিকী বলেন, দেশের একমাত্র বিরোধীদলের কাগজ এটি। এছাড়া আর কোন কাগজ নাই।
“আমরা বলেছি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত এটা আপনার বন্ধ করছেন।” বলেন তিনি।
তার মতে, বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোর খবর যেভাবে পত্রিকটি ফলাও করে প্রচার করেছে সেগুলো সরকার ‘বোধহয়’ পছন্দ করেনি। যার কারণে এটি বন্ধের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
এ বিষয়ে তথ্য অধিদপ্তর(পিআইডি) এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ভিন্ন মত নিয়ে কাজ করেন এমন বিশ্লেষকরা বলছেন যে, দেশে ভিন্ন মতের সংবাদ মাধ্যম বন্ধের বিষয়গুলো নতুন নয়। দেশের এক সময়ের বহুল জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের সম্প্রচার দীর্ঘ সময় বন্ধ রাখা হয়েছিল আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁদে ফেলে।
অভিযোগ রয়েছে যে, এরআগে ২০১০ সালে ‘আমার দেশ’ নামে একটি পত্রিকাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেটি বিএনপির মালিকানার বলে। এছাড়া ভিন্ন মতের কারণে আরো অন্তত দুটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রচার বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ক্ষমতাসীন দলে যারা থাকেন তাদের দলের লোকজন আইনি দুর্বলতা নিয়ে প্রকাশনা চালিয়ে গেলেও সেগুলো আমলে নেয়া হয় না। আবার তারাই যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন প্রতিপক্ষ তাদের আইনি মারপ্যাচে ফেলে প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। এ দুটোই মারাত্মক প্রবণতা বলে মনে করেন তিনি।
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দল তাদের বিরোধীদলের আইনগত ত্রুটি খুঁজে পান, নিজের দলেরটা খুঁজে পান না- এমন প্রবণতা সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার প্রতি, বাক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।