স্বীকৃতিতেই বন্দি অধিকার

0

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশের সংবিধানকে আদর্শস্থানীয় বলে মনে করেন অনেকেই। যেমন সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’

তবে সংবিধানের ৫০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের শাসনব্যবস্থার ১৮ বছরই কেটেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনে। আবার গণতান্ত্রিক সরকারগুলোও ক্ষমতাকে সুসংহত করতে গিয়ে পদে পদে সংবিধানকে পাশ কাটিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক মানবাধিকারকেও সংকুচিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জন্য সামরিক শাসক ও রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সাই প্রধানত দায়ী।

সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ দলিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর এই সংবিধান সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। এটা কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর।

সংবিধানের ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে শ্রেণিবৈষম্য নিরসন, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, জবরদস্তি শ্রমের অবসান, চিন্তা-বিবেক ও বাকস্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকারসহ এ ধরনের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে এর বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

কিন্তু সংবিধানের ৫০ বছরে এসে প্রশ্ন উঠেছে, দেশের শাসনব্যবস্থা ও জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সংবিধান কতটা কার্যকর রয়েছে?

দেশি-বিদেশি তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মৌলিক অধিকারের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনও স্বীকৃতির সীমাতেই বন্দি হয়ে আছে। ফলে স্বাধীনতার ৫১ বছর এবং সংবিধান কার্যকরের ৫০ বছরেও এসব অধিকারের পুরো সুফল পায়নি জনগণ।

বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া সর্বপ্রথম গণপরিষদে উত্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর। এদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় না, দশ মাসের মধ্যে কোনো দেশ শাসনতন্ত্র দিতে পেরেছে। আমি নিশ্চয়ই মোবারকবাদ জানাব শাসনতন্ত্র কমিটির সদস্যদের। মোবারকবাদ জানাব বাংলার জনসাধারণকে। রক্তে লেখা এই শাসনতন্ত্র…। শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ- তার অর্থ হলো মাঝিবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও থাকবে। এখানে ফ্রি স্টাইল ডেমোক্রেসি চলতে পারে না। শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার থাকবে, কর্তব্যও থাকবে। এবং যতদূর সম্ভব, যে শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়েছে, টোটাল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’

তবে জনগণ সাংবিধানিক অধিকার কতটুকু ভোগ করতে পারছে, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, সার্বিকভাবে এ কথা বলা অন্যায় হবে না যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়িত করতে এবং সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমতা এখনও নিশ্চিত হয়নি। আইন ও বিচারব্যবস্থায় একজন সাধারণ মানুষের চেয়েও প্রভাবশালীরা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

গত ২৬ অক্টোবর বৈশ্বিক আইনের শাসনের সূচক প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি)। সংস্থাটির তথ্যমতে, আইনের শাসনের সূচকে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে ২৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ, বৈষম্যের শিকার জনগণ এই অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। ভ্রান্ত ধারণাও আছে যে তারা ন্যায়বিচার পাবেন না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো ছাড়া এখনও যে কোনো বিষয়ে উচ্চ আদালতে কমবেশি সুফল পাওয়া যায়। তাই এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্নিষ্টদেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’

সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে এখনও কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ গত ১৪ বছরে বহুলাংশে এগিয়েছে।

গত ১৪ জুলাই বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, লিঙ্গ সমতায় ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশ রয়েছে নবম স্থানে। বিপরীতে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যও বেড়েছে।

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের (২০১৯) তথ্যমতে, অতি ধনীর বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে, যে হার সারাবিশ্বে তৃতীয়। বিপরীতে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এখনকার রাজনীতি বিত্তশালীদের দখলে। মন্ত্রী-এমপিদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। তাঁদের কেউ আগে রাজনীতি করেননি, যার প্রভাব রয়েছে রাষ্ট্রের প্রশাসন কাঠামোতে। তাই এখনও শ্রেণিবৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়া সম্ভব হয়নি।

সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ; এবং এই বিধান কোনোভাবে লঙ্ঘিত হইলে তাহা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।’ কিন্তু এই অনুচ্ছেদের পরও শিশুশ্রম বন্ধ করা যায়নি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে, দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ লাখ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসূচি সমন্বয়ক সৈয়দা মুনীরা সুলতানা সমকালকে বলেন, বিভিন্ন কৌশলে শিশুদের জোর করে কাজ করানো হয়। বিশেষ করে গৃহকর্মী, পর্নোগ্রাফি, যৌনবৃত্তিসহ এ ধরনের কাজগুলো শিশুদের জবরদস্তি করানো হচ্ছে। তা ছাড়া দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও শিশুরা বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এতে দরিদ্র পরিবারেরও সায় থাকে। এর ফলে শিশুরা জীবনের শুরু থেকেই পদে পদে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য সরকারের সমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা দরকার।

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক ও সাংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা শর্তসাপেক্ষে নিশ্চিত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে জনস্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ ছাড়া সংবিধানের ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশের যে কোনো স্থানে অবাধ চলাফেরা, সমাবেশ বা সংগঠন করা, দেশত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশের স্বাধীনতাও দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের।

কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে, এই অধিকারগুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২৭টি ঘটনায় ২১৩ জন সাংবাদিক আহত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ ছাড়া সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ১৪০টি, যাতে ভুক্তভোগী হয়েছেন ১ হাজার ১৬৫ জন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সংবিধানে বর্ণিত চার মূলনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গত ১৪ বছর বঙ্গবন্ধুর গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ মসৃণ হয়নি। বরং এই সময়ে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর রাষ্ট্র ও সংবিধানবিরোধী অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণেই ব্যস্ত থেকেছে ক্ষমতাসীন দলটি।

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী সমকালকে বলেন, ‘সংবিধানের ৫০ বছরে বারবার আঘাত এসেছে। ১৭ বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংবিধানের মৌল ভিত্তিই বিনষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্র যে নীতি অবলম্বন করে চলবে, সেই নীতিই সংশোধিত হয়েছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর নীতিগুলো পুনঃস্থাপিত হলেও সংবিধানে এখনও সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এসব করছে। আর এসব কারণে নানাভাবে জনমতও উপেক্ষিত হচ্ছে। উপেক্ষিত রয়ে গেছে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারও।’

উৎসঃ   সমকাল
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More