অপরাধী পুলিশ সদস্যদের লাগাম টেনে ধরবে কে?

0

policeসিরিজ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কতিপয় অসাধু ও বেপরোয়া পুলিশ সদস্য। এ নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই নতুন করে নানা অপরাধের ঘটনার জন্ম দিচ্ছে এসব দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য। বিশাল পুলিশ বাহিনীর মুষ্টিমেয় ‘কলঙ্কিত’ ও ‘বেপরোয়া’ এই সদস্যদের লাগাম টেনে ধরবে কে? এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে। এর সঙ্গে থানার ওসি ও এসআইদের ছত্রছায়ায় থাকা সোর্সরা আরো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
দেশের কোনো না কোনো এলাকায় প্রায় প্রতিদিন সাধারণ মানুষ অকারণে একশ্রেণীর পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। কখনো সাজানো অভিযোগে আটক করা হয়। মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। চাঁদাবাজি, হত্যা, নারী নির্যাতনসহ নানা গুরুতর অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের ঘটনার পর শুধু প্রত্যাহার কিংবা সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) লোক দেখানো (আইওয়াশ) বলেও কেউ কেউ মনে করেন। অপরাধী এসব পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবেই দিন দিন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ডিএসসিসি কর্মকর্তাকে অকারণে নির্মম নির্যাতনসহ পুলিশের ধারাবাহিক কয়েকটি অপরাধের ঘটনা সামাল দিতে     যখন শীর্ষ পুলিশ কমকর্তারা ব্যস্ত ও বিব্রত, এর মধ্যে বুধবার রাজধানীর মিরপুরে আবারো হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এ দিন রাতে শাহআলীর বালুমাঠ এলাকায় চাঁদা না পেয়ে পুলিশের ছোড়া তেলের চুলার বিস্ফোরণে চা-দোকানি বাবুল মাতুব্বর দগ্ধ হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রাণ হারান। এ ঘটনা নিয়ে ওই এলাকাবাসীর মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দেয়।
চা দোকানিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় শাহআলী থানার দুই এসআইসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য ও পুলিশের একজন সোর্সকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন নিহতের কন্যা। ঘটনায় জড়িত দুই এসআইসহ চার পুলিশ সদস্যকে গতকাল বিকেলে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে দুটি তদন্ত কমিটি।
শাহআলীর ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক আখ্যায়িত করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, মুষ্টিমেয় কয়েক জন পুলিশ সদস্য যদি এভাবে একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সকল মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়বে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া না হলে দেশের সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, যার পরিণতি ভালো হবে না। তিনি বলেন, দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তি কেবল প্রত্যাহার কিংবা বদলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তাদের লাগাম টেনে ধরা যাবে না। আর তা না হলে গোটা পুলিশ বাহিনীর হাজারো ভালো কাজ মাত্র কয়েকটি অপরাধে ঢেকে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেবে।
শাহআলীতে চা বিক্রেতাকে পুড়িয়ে হত্যার আগে গত রোববার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্থার অভিযোগ ওঠে আদাবর থানার এসআই রতন কুমারের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে করা মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া গত জানুয়ারিতে মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে পুলিশের হামলার শিকার হলেন দুই ব্যক্তি। নির্যাতনের শিকার দু’জনই সরকারি কর্মকর্তা। একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক গোলাম রাব্বী। অন্যজন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাস। গত মাসের শেষ সপ্তাহে উত্তরায় বান্ধবীসহ এক ব্যবসায়ীকে রাতভর আটকে রেখে আড়াই লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন কয়েকজন অসাধু পুলিশ সদস্য। প্রায় একই সময় যাত্রাবাড়ী থানার ওসিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী ওই নারী আদালতে মামলাও করেছেন। এছাড়া গত সপ্তাহে কাফরুলে একজন সিনিয়র সচিবের ছেলের শার্টের পকেটে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা চালায় পুলিশ। ডিএমপি সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি অপরাধের তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের স্বজনসহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, গুরুতর অপরাধে জড়ানোর পরও পুলিশের অনেক সদস্যকে সাজা হিসেবে শুধু প্রত্যাহার ও সাসপেন্ড করা হয়, যা মোটেই যথেষ্ট নয়, পরে আর তদন্তও এগোয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো লোক দেখানো বা আইওয়াশ। কিছুদিন পরই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য অন্যত্র বদলি হয়ে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে। তাই অনেক পুলিশ সদস্য বেপরোয়া আচরণ করার সাহস দেখাচ্ছে। কোনোভাবেই দুর্নীতিবাজ এসব পুলিশ সদস্যকে দমন করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, শাহআলীতে পুলিশের দ্বারা যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ডিএসসিসি কর্মকর্তাকে নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পরবর্তীতে অন্য কোনো পুলিশ সদস্য এভাবে অপরাধে জড়াতে সাহস করত না। তিনি বলেন, সব সরকারের আমলেই পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতিতে আর্থিক লেনদেন, আঞ্চলিকতা ও দলীয় সিন্ডিকেট অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা হিসেবে কাজ করছে। থানায় পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ ও বদলি স্থানীয় এমপির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বিচারক, সাবেক পুলিশপ্রধান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিবদের নিয়ে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন করে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তার তদন্ত করা জরুরি।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম দাবি করে বলেন, পুলিশ বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্যের মধ্যে মুষ্টিমেয় সদস্য অপরাধে জড়াতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটি ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দোষীদের ছাড় দেয়া হচ্ছে না। কিছু অপরাধী পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় গোটা বাহিনীর ওপর চাপানো মোটেই সমীচীন নয়। ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, অপরাধী পুলিশ সদস্যরা শুধু লঘুদণ্ড পাচ্ছে, এমন অভিযোগ মোটেই সঠিক নয়। বিভিন্ন অপরাধ কিংবা অনিয়মের কারণে ২০১৫ সালের নয় হাজার ৯৫৮ পুলিশ সদস্যকে বিভাগীয় শাস্তি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দুই ধরনের সাজা দেয়া হয়। লঘু দণ্ড ও গুরু দণ্ড। ফৌজদারি অপরাধে জড়িত হলে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। অন্যান্য দণ্ডের মধ্যে আছে- পদাবনতি, বেতন কাটা ও পদোন্নতি আটকে দেয়াও হয়ে থাকে।
অসাধু পুলিশ সদস্যদের আরো কিছু ঘটনা : বিগত ২০১৫ সালে ডেমরার ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলামের ১৯ লাখ টাকা ছিনতাই করার অভিযোগে গ্রেফতার হন কাফরুল থানার এসআই রফিকুল ইসলাম। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভাটারা থানার তৎকালীন পরিদর্শকের (তদন্ত) বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী মাসুদ খানকে আটক করে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করার অভিযোগ ওঠে। পরে মাসুদ খানকে অন্য একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ১৪ জুন খিলগাঁও থানা পুলিশের এএসআই মোশারফ হোসেনের বিরুদ্ধে তার সাবেক স্ত্রীকে আটকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে ৩০ নভেম্বর কাফরুলের ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন কামাল হত্যা মামলার আসামি এসআই রেজাউল করিম আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে পালিয়ে যান। এছাড়া গত বছর পুলিশের বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় দুর্নীতিতে জড়ান নড়াইল জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পদোন্নতির পরীক্ষায় ঘুষ দিতে ‘ঘুষফান্ড’ গঠন করে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কয়েকজন সদস্য। এ ঘটনায় পুলিশের উপকমিশনার জিল্লুর রহমান, এএসআই আনিসুজ্জামান, এএসআই মনির হোসেন, নায়েক কবির হোসেন, চালক শহীদুল ইসলাম, বাবলু জমাদ্দারসহ কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে ধানমণ্ডির শংকরের বাসা থেকে আটক করে মিরপুর থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ১৭ জুলাই মিরপুর থানায় এসআই জাহিদুল ইসলাম, এএসআই রাজকুমার, কনস্টেবল আনোয়ার হোসেনসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More