ক্রসফায়ারে তিন সপ্তাহে নিহত ২৬ঃ আমাদেশ

0

08.02.2015ঢাকা: পাল্টেছে ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ধরন। আগে যেখানে পেশাদার সন্ত্রাসীরা নিহত হতো, এখন সেখানে নিহত হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মী। একই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ‘গাড়িচাপায়’ নিহত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
গত তিন সপ্তাহে এভাবে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘গাড়িচাপায়’ নিহত হয়েছেন ২৬ জন। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী, যশোর ও চৌদ্দগ্রামে ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জামায়াত-শিবিরের তিন নেতা নিহত হয়েছেন।
সর্বশেষ শনিবার দিবাগত গভীর রাতে ঢাকার আগারগাঁওসহ কুমিল্লা ও যশোরে র‌্যাব-পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন আরো তিন যুবক। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার জোড়কানন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন স্বপন প্রকাশ ওরফে কালা স্বপন (৩৫)। আর যশোরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রাজু ওরফে ভাইপো রাজু (৩৩)।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন কাটাখালি বাজারে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তথ্য গবেষণা সম্পাদক শাহাবুদ্দিন, বিনোদপুর আবাসিক মেস শাখার সভাপতি মফিজুর রহমান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহিদ হবিবুর রহমান হল সভাপতি হাবিবুর রহমান বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে যান।
সেখান থেকে ফিরে মোটরসাইকেলে কাটাখালি পৌরসভার সামনে এলে মতিহার থানা পুলিশ তাদের আটক করে। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনজনকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার শাহাবুদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে মতিহার থানার ওসি বলেছেন, পুলিশকে আক্রমণ করতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাহাব পাটওয়ারী (২৪) পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। নিহতের মা ছাকিনা বেগম বলেছেন, তার ছেলেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার পরে সাদা পোশাকধারী পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সকালে হাসপাতালে তার লাশ পাওয়া যায়।
সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন শহিদুল ইসলাম নামে এক জামায়াত কর্মী। তবে পুলিশ বলেছে, শহিদুলকে আটকের পর তিনি পুলিশের গাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অজ্ঞাত (২৩) নামে এক যুবক নিহত হন। ৪ ফেব্রুয়ারি ভাষানটেক থানা এলাকা থেকে আল আমিন (৩০) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে সাখাওয়াত হোসেন রাহাত ও মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ নামে দুই যুবক নিহত হন।
৩ ফেব্রুয়ারি যশোরের মনিরামপুর থেকে যুবদল কর্মী লিটনকে বোমা হামলাকারী মনে করে আটক করে। পরে পুলিশ হেফাজতে ‘ট্রাকচাপায়’ তার মৃত্যু হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি মনিরামপুরের যুবদল কর্মী ইউসুফকে বোমা হামলাকারী মনে করে পুলিশ আটক করে। পরে পুলিশ হেফাজতে ‘ট্রাকচাপায়’ তার মৃত্যু হয়।
১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সাইদুল ইসলাম নামে এক জামায়াত নেতা পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরদিন তিনি মারা যান। ১ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকার শাহআলী থানা সভাপতি এমদাদ উল্লাহ পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন।
২৯ জানুয়ারি সদরঘাটের লঞ্চ থেকে সাদা পোশাকের লোকজন নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ছাত্রদল নেতা আরিফুল ইসলাম মুকুলকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন তার লাশ পাওয়া যায় রূপনগর এলাকায়। গত ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শিবিরকর্মী সাকিবুল ইসলামকে পুলিশ আটক করে। পরে পুলিশি নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৯ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।
২৯ জানুয়ারি রাজশাহী মহানগর বিএনপি নেতা আইনুর রহমান মুক্তাকে পুলিশ আটক করে নির্যাতন করায় তার মৃত্যু হয় বলে দলীয় সূত্র জানায়। ২৭ জানুয়ারি সাতক্ষীরার তালায় রফিকুল ইসলাম নামে একজনকে ডাকাত মনে করে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়।
২৭ জানুয়ারি রাজশাহীর বিনোদপুরে জামায়াত নেতা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম শাহীনকে আটকের পর ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়। ২৭ জানুয়ারি ইসলামী ছাত্রশিবির চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিটি কলেজ শাখা শিবিরের সভাপতি আসাদুল্লাহ র‌্যাবের হাতে আটক হন। পরে র‌্যাব হেফাজতে থাকা অবস্থায় ট্রাকচাপায় নিহত হন তিনি।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার কুসুমবাড়ি গ্রামের হাশেম আলী বিশ্বাসের ছেলে ৩৫ দিন নিখোঁজ থাকার পর ২৬ জানুয়ারি র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। ওই দিনই ক্রসফায়ারে আবুল কালাম নামে আরো একজন নিহত হন। লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা জিসান ২২ জানুয়ারি দাউদকান্দি এলাকায় র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন।
২০ জানুয়ারি রাজধানীর খিলগাঁও জোড়পুকুর পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনির (৩০) লাশ। নিহতের বাবা ইয়াকুব আলী জানান, তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মহানগর পুলিশের দাবি, জনির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাকে নিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধারে বের হলে খিলগাঁও জোড়পুকুর পাড় এলাকায় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এ সময় পাল্টা গুলি চালালে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গত সোমবার ভোর রাতে নিহত হয়েছেন নড়াইল পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ইমরুল কায়েস (৩৪)। তিনি ওই ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।
১৯ জানুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা সভাপতি মোহাম্মদ এসলাম পুলিশ হেফাজতে ট্রাকচাপায় নিহত হন।
১৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পূর্ব টিমের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ইমরুল কায়েস নিহত হন বলে জানা যায়। ইমরুলের স্ত্রী জান্নাতুল বলেছেন, তার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, তার স্বামী জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তাকে হত্যা করা হয়। তার স্বামী নির্দোষ। তবে পুলিশের দাবি কায়েসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট এলাকায় র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান (৩০)। ঘটনার পর র‌্যাব-৫ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর কামরুজ্জামান ঘটনার পর সাংবাদিকদের বলেন, বিশেষ অভিযানে মতিউরসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে নাশকতার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে তাকে নিয়ে র‌্যাব অভিযানে বের হলে মতিউরের সহযোগীরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এ সময় র্যা বও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলির একপর্যায়ে মতিউর গুলিবিদ্ধ হয়।
তবে মতিউরের পরিবারের দাবি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইং প্রধান মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, মতিউরের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপসহ নাশকতায় জড়িত থাকারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ক্রসফায়ারের নামে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে তা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। অতি উৎসাহ দেখিয়ে যারা এভাবে হত্যা করছেন তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীতিমালা ও আচরণবিধি রয়েছে। কেউ অতি উৎসাহ দেখালে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এর দায় ততোটা নেবে না। যে ঘটাবে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More