নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস: ২০ লাখেই মিলবে গ্রিন সিগন্যাল

বিএলআরআইয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ২২ পদে নিয়োগে চার কোটি টাকা ঘুস লেনদেনের অভিযোগ

0

চাকরি প্রার্থী : হ্যালো, আপনার কি মিটিং শেষ হয়েছে?

কর্মকর্তা : এই তো শেষের দিকে। আচ্ছা ঠিক আছে, বলেন কী বলবেন।

চাকরি প্রার্থী : আমাকে তো…বলছিল, আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। এখন হচ্ছে, আপনার সঙ্গে যে বিষয়ে কথা হয়েছে ওর, তারপর তো আমরা ফ্যামেলিতে সবাই মিলে কথা বললাম। এখন আপনি তো ওর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, মেবি ২০ লাখ।

কর্মকর্তা : ইয়ে, শোনেন আপনার নামটা কী আমি জানি না। আর আমি ফোনে এসব ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি না। আমি….ওকে অনেকবার ফোন দিয়েছি।

চাকরি প্রার্থী : আপনার এই নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ আছে নাকি?

কর্মকর্তা : না…যদি যেটা আমাকে বলছো, ওইটাতে হইলে আমি তোমাকে নক করব। তারপরও আমি বলে রাখছি, ভাইবাতে, মেবি ভাইভার আগের দিন তোমাদের কিছু কোশ্চেন সাপ্লাই করা হবে। যাদের ই…করা হয়। এই জন্য ওনারা…মেবি ওনারা ইয়ে…হচ্ছে। তুমি প্রিপিয়ার্ড থাকো। যদি আমি তোমাকে গ্রিন সিগন্যাল দিই, তুমিও সেভাবে…আমি যেভাবে বলব সেভাবে আগাবা।

এগুলো কোনো নাটক বা সিনেমার সংলাপ নয়। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে চাকরি প্রার্থীর সঙ্গে সংস্থাটির এক নারী কর্মকর্তার কথোপকথন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ওই প্রার্থী চাকরি পেতে ঘুসের অঙ্ক নিয়ে যে আলাপ করেছেন তাতেই ফাঁস হয়েছে নিয়োগ বাণিজ্যের ভয়াবহ তথ্য।

কর্মকর্তা ও চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে উল্লিখিত কথোপকথনের ৫২ সেকেন্ডের একটি অডিও ক্লিপের সূত্র ধরে যুগান্তর অনুসন্ধানে নামে। এতে বেড়িয়ে আসে বিএলআরআই-এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ২২টি পদে নিয়োগ বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযোগ আছে, জনপ্রতি ২০ লাখ টাকা করে ঘুস নিয়ে ২২ জনের চাকরি নিশ্চিত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে চার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে একটি সিন্ডিকেট।

জানা যায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)। এই সংস্থায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ২২টি পদে নিয়োগের জন্য ২৭ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন দিনে লিখিত পরীক্ষা হয়। গত ২৬ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর নেওয়া হয় মৌখিক পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সংস্থার কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্যে মাঠে নামে। তারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চাকরি নিশ্চিত করতে তাদের কাছে ২০ লাখ টাকা করে ঘুস দাবি করেন। সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য প্রতিষ্ঠানের ছাগল উন্নয়ন গবেষণা বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিপি রাণী সরকার তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও একই নম্বরের হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করে একাধিক চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে ঘুস লেনদেনের আলাপ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আলাপকালে তিনি প্রার্থীদের একজনকে বলেন, বিএলআরআই-এর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী নাসরিন সুলতানা এবং অতিরিক্ত পরিচালক জিল্লুর রহমান নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করবেন। চাহিদামতো ঘুসের অঙ্ক নিশ্চিত হলে মহাপরিচালকের স্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে কথা বলবেন। মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী নাসরিন সুলতানা নিজেও সংস্থাটির পরিচালক (গবেষণা) পদে কর্মরত।

এক চাকরি প্রার্থীর সঙ্গে আলাপচারিতায় লিপি রানী সরকার বলেন, ‘ডিজি সাহেবের স্ত্রীর বান্ধবী মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা। যারা এর মধ্যে চাকরির জন্য টাকা দিয়েছেন, তারা সরাসরি ডিজির স্ত্রীর কাছে দিয়েছেন। তাদের চাকরি নিশ্চিত।’

প্রতিষ্ঠানটিতে আলোচনা হচ্ছে, লিপি রাণী সরকারসহ কয়েক কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। চাকরি প্রার্থী ২২ জনের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকারও বেশি আদায় করতে সক্রিয় এ সিন্ডিকেট সদস্যরা। ইতোমধ্যে কিছু প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্যের পুরো মিশন শেষ না হওয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পরও নির্বাচিত প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না। শুধু ঘুসের টাকা জোগান দিতে না পারায় মেধাবীদের অনেকেই চাকরি বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় আছেন। তারা নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রাণালয়ে অভিযোগও করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রার্থী যুগান্তরকে বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই লিপি রানী সরকার মোবাইল ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চাকরি নিশ্চিত করতে তিনি ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু আমি জানি বিএলআরআইয়ে কোনো পেনশন স্কিম নেই। অনলি গ্র্যাচুয়িটি। এ কারণে আমি এত টাকা দিয়ে চাকরি নিতে রাজি হইনি। আমি এখন গাজীপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। ভালোই আছি। অনেকেই হয়তো জেনে কিংবা না জেনে এত টাকা দিয়েছে। মনে করেছে সরকারি চাকরি।’ এক প্রশ্নের জবাবে এই চাকরি প্রার্থী জানান, ‘লিখিত পরীক্ষা শতভাগ ফেয়ার হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বাণিজ্যের ফাঁদে ফেলছে চক্রটি। গত বছর একই পদে নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা মিলিয়ে চুক্তি হয়েছিল। এ কারণে অতি দ্রুত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল। যাতে কেউ নিয়োগ ঠেকাতে না পারে। এবার একযোগে স্বার্থ হাসিল করতে না পারায় চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশে টালবাহানা চলছে।’

চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে ঘুসের চুক্তি নিয়ে আলাপচারিতার বিষয়ে জানতে চাইলে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিপি রাণী সরকার বলেন, ‘যে অডিও রেকর্ডের কথা বলা হচ্ছে সেটা বানোয়াট। এখন ডিজিটাল যুগ। একজনের কণ্ঠ হুবহু নকল করা যায়। কেউ ষড়যন্ত্র করে এটা করেছে। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’

সংস্থাটির পরিচালক ড. নাসরিন সুলতানা বলেন, ‘আমি নিয়োগ কমিটির সদস্য নই। নিয়োগসংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। আসলে আমার স্বামী সংস্থার ডিজি, আমি পরিচালক, এটা যারা ভালোভাবে নিতে পারছে না, তাদেরই কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

এদিকে শুধু নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য নয়, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ নৈতিকস্খলনের অভিযোগও আছে। সংস্থায় কর্মরত নারী কর্মকর্তারা তার লালসার শিকার হচ্ছেন মর্মে লিখিত অভিযোগও করা হয়। অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে দুই নারী কর্মকর্তার নামও উল্লেখ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক বিভাগীয় তদন্তও হয় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। তদন্ত শেষে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘অভিযোগটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যথাসম্ভব সতর্কতার সঙ্গে অভিযোগটি তদন্তের চেষ্টা করে দেখা যায় এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে। কেউ বিষয়টি নিয়ে স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও সত্যতা অস্বীকার করেনি।’ আরেকটি লিখিত অভিযোগে বলা হয়, গত চার বছরে তিনি বিভিন্ন প্রকল্প থেকে নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে ফারহানা আফরোজ নামে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, আউটসোর্সিং কর্মচারী তানিয়ার নামে ৫৫ লাখ টাকা, দৈনিক হাজিরা শ্রমিক প্রীতি সাহা নামে ৪০ লাখ টাকা ও নূরুন্নাহারের নামে ২৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন।-এই অভিযোগের তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সংস্থার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফারহানা আফরোজের নামে ১৭ লাখ টাকা, তানিয়া আক্তার ইতির নামে ৭ লাখ ও প্রীতি রাণী সাহার নামে ১৩ লাখ টাকার উন্মুক্ত চেক বিভিন্ন সময় প্রকল্প থেকে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এত বিপুল পরিমাণ টাকা উন্মুক্ত চেকে উত্তোলন বিধিবহির্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থ আত্মসাৎ ও নৈতিকস্খলনের অভিযোগের সত্যতা তুলে ধরা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিষয়গুলো ধামাচাপা দিয়ে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।

উল্লিখিত বিষয়ে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমি বা আমার স্ত্রী ঘুস বাণিজ্যের কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। কেউ আমাদের নাম ব্যবহার করে থাকতে পারেন। এখানে যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে তাতে কার চাকরি হবে, কেউ বলতে পারবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপের কথা আমি শুনেছি। এগুলো ঠিক না। পরবর্তী ডিজি প্যানেলে আমার স্ত্রীর নাম আছে। তাই একটি মহল পরিকল্পিতভাবে এই ষড়যন্ত্রে নেমেছে।’ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বেনামে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল তদন্ত কমিটি সেসব অভিযোগের সত্যতা পায়নি।’

jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More