খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা

0

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কঠিন শর্তেও খেলাপি ঋণের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় ও ঋণ গ্রহীতাদের নানা সুযোগ দেওয়ার পরও বাড়ল খেলাপি ঋণ। গত এক বছরের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। ডিসেম্বরের শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এক বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বাড়লেও গত তিন মাসের হিসাবে কমেছে ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে এ ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনিংয়ের প্রতিবেদনটি রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অনুমোদন করেছেন। প্রতি তিন মাস পর পর প্রতিবেদনটি হালনাগাদ করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

সূত্র জানায়, বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলার জন্য সরকার আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তিও পেয়েছে। এই ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। আগামী জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি ঋণের তথ্য আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে সব সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের অনেক বেশি। আইএমএফের এমন শর্তের মধ্যেই এক বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে তিন মাসের হিসাবে কিছুটা কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছরজুড়ে খেলাপি ঋণ নবায়নে ঋণ গ্রহীতাদের বড় ছাড় দেওয়া হয়। এর প্রভাবে অনেকে খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছেন। যে কারণে গত তিন মাসের হিসাবে কিছুটা কমেছে।

জানা গেছে, প্রভাবশালীদের চাপ ও নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেওয়া ঋণ ফেরত আসছে না। ওইসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় খেলাপি থাকার পর সেগুলো আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে। মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ফলে ব্যাংকের দ্বিগুণ অর্থ আটকে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের বড় একটি কারণ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এমন পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় আরও বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই খেলাপি হবে না বলে নীতিমালা জারি করে। এতে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর সময়ে মন্দ ঋণ কিছুটা কমলেও এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির সময় ব্যাংক ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ ছাড় ও নানা সুবিধা। ২০২২ সালের শুরুতে তা তুলে নেওয়ার পর ধারাবাহিক বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ। গেল বছর ঋণের কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলে খেলাপি মুক্ত থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু তাতেও খেলাপি ঋণ না কমায় সেপ্টেম্বর থেকে এ সুবিধা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সুবিধার ফলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যারা ঋণের কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছেন তারা কেউ খেলাপি হননি।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে এটি আসলে আন্তর্জাতিক মানের নয়। কারণ এখানে অনেক তথ্য থাকে না। আবার খেলাপি কম দেখাতে অনেক তথ্য যোগ করা হয় না। ঋণ পুনঃতফশিল, পুনর্গঠন ও ঋণ অবলোপন করার তথ্য দেওয়া হয় না। পাশাপাশি বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয় শুধু আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর জন্য, যা কখনোই মানসম্পন্ন বলা যাবে না। বিশেষ কৌশলে নানা ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো কাম্য নয়। এতে কাগজে-কলমে খেলাপি কমলেও ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। অন্যদিকে আমানতকারীদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে কমেছে তিন মাসের হিসাবে। মূলকথা হলো এটা খেলাপির প্রকৃত চিত্র নয়। অবস্থার উন্নতি হয়নি। নানা ছাড় ও সুবিধার ফলে এমনটি হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ অবলোপন, আদালতের নির্দেশে খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখানো ও নবায়ন করা ঋণখেলাপি হওয়ার চিত্র মিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। এর বেশি হলেই তা ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণস্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তারও আগে দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণস্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আলোচ্য তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

২০২১ সালের ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে গেল বছর (২০২২ সাল) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। তবে ত্রৈমাসিকের তুলনা করলে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে অনেক দিন ধরে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ঋণ পরিশোধ ব্যাহত হচ্ছে। ঋণ আদায় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নীতি সহায়তাও দেওয়া হয়েছে। এসব নীতি সহায়তার কারণে খেলাপি ঋণ শেষ প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে সবচেয়ে বেশি হয়েছে ২০২২ সালে। বছরটিতে খেলাপির অঙ্ক ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে খেলাপি ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২০ সালে খেলাপির অঙ্ক ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি, ২০১৯ সালে খেলাপি ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি এবং ২০১৮ সালে খেলাপি ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More